অনালোকিত সাঁওতাল গ্রাম সমাজের উপাখ্যান



দীপেন্দু চৌধুরী
ভারতে পাহাড়ি উপত্যকায় যেসব আদিবাসী এবং জনজাতিরা থাকেন তাঁরা কেমন আছেন? একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে তাঁরা শিক্ষার আলো কতটা পেয়েছেন? বুনিয়াদি শিক্ষা (লিখতে-পড়তে পারা এবং গণিত শিক্ষা) আমাদের দেশে মূলত চলে বিদেশী আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত সর্বশিক্ষা মিশন প্রকল্পের মাধ্যমে। এর বাইরে আছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এবং এছাড়াও আছে বিভিন্ন বেসরকারি অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মুক্তি মূর্মু (নাম পরিবর্তিত) বীরভূম জেলার রাজনগর ব্লকের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের আদিবাসী মেয়ে। ঝাড়খন্ড-বীরভূম লাগোয়া সবুজ ঘেরা গাছ গাছালি। শাল-সেগুন, শিমূল, পলাশ, মহুয়া গাছের শ্যামল ছায়া। সবুজ শুকনো হয়ে ঝড়ের ডাক দেয়। পাখ-পাখালি আর লালমাটির প্রত্যন্ত গ্রামের সহজ সরল মেয়ে মুক্তি। আর্থিক অভাবের কারণে স্কুলে পড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। স্কুলের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে মুক্তি পড়াশোনায় খুব একটা খারাপ ছিল না। কিন্তু বাড়িতে আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে বাবা-মা মেয়েকে আর পড়াতে চায়নি। মা-বাবার ইচ্ছে মেয়ে ‘ফুটবল’ খেলা শিখুক। তাহলে একটা সরকারি চাকরি পাবে। মুক্তির মা আশা। গ্রামের জমিতে কৃষি মজুর হিসেবে কাজ করেন আশা। তার ইছা তার মেয়ে মুক্তি পুলিশে চাকরি করুক। সে শুনেছে স্থানীয় থানা মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এবং ভালো খেলে এমন মহিলা ফুটবলারদের চাকরির প্রস্তাব দেয়। সুতরাং তার মেয়ে মুক্তিও ভালো ফুটবল খেললে সেও পুলিশে চাকরি করতে পারে।
আশা ‘শ্রীজা ইন্ডিয়া’ নামে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে গিয়ে আবেদন করে তার মেয়েকে এই সংস্থায় নাম নথিভুক্তি করে নেওয়া হোক। তাহলে এই সংস্থার ক্রীড়া কেন্দ্রিক শিক্ষা কর্মসূচীর আওতায় তার মেয়ে ফুটবল শিখে চাকরি পেতে পারে। ফার্স্ট জেনারেশন লার্নারসঃ এ শ্রীজা ইন্ডিয়া পারস্পেক্টিভ (First Generation Learners: A Shreeja India Perspective) নামে এই সংস্থা সম্প্রতি একটি ব্যাতিক্রমী অভিঞ্জতার সম্মুখীন হয়েছে। অলাভজনক এই সংস্থাটি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে ক্রীড়ানির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া গৃহস্থ হিংসা, কুমারী বিয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে থাকে এই সংস্থার প্রশিক্ষিত আধিকারিক এবং কর্মীরা।       
রাজনগর গ্রামের হত দরিদ্র শিক্ষার আলো পৌছয়নি এমনই পরিবারের একটি আদিবাসী মহিলার অনুরোধ শুনে শ্রীজা ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টার ডঃ শিবশঙ্কর দাশগুপ্ত তার সংস্থার বীরভূমের রাজনগর অফিসে বসে তাঁকে  বলেন, ‘’আপনার মেয়ে ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিতে নিতেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি আপনার মেয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার সব সাহায্য আমাদের সংস্থা করবে। এবং ফুটবলের প্রশিক্ষণও সে পাবে আমাদের সংস্থা এই কাজই করে থাকে।‘’
 ‘’আমাদের চিন্তায় উসব লায় বাবু। আমার মেয়া মুক্তি কলেজ থেকি পড়া চালিং বিএ পাশ দিবে? উয়ার লক্তেই লায় উসব। অক্ষর চিনবে কুথা থেকি? আমি বলতে লাড়ব কিন্তুক শুন বাবু আমার মেয়ার লক্তে ‘ফুটবল খেলা’ আছেক। এই আমি বললুম। উয়ার বাবার যখন বয়সটো কম ছিল তখন আহমাদের জেলার ফুটবল দলে খেলাছে বটেক।‘’ আশা উত্তরে বলে।
পরের দিন মুক্তির মা শ্রীজা ইন্ডিয়ার অফিসে আবার আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন মুক্তির বাবাকে। শিবশঙ্করবাবুর কথায় ‘’আমরা আবার আলোচনায় বসি সঙ্গে চা এবং বিস্কুট নিয়ে। আমরা বসি আমাদের স্কুলের একটি ক্লাসে। মুক্তির বাবা বেশি কথা সেদিন বলেননি। অতি সাধারণ কোনও কাজ করে সে। হতদরিদ্র মানুষটির বুনিয়াদি শিক্ষাটুকুও হয়নি।‘’  
অত্যন্ত সংকোচে আমতা আমতা করে সেদিন মুক্তির বাবা বলেন, ‘’আমার মেয়ের শিক্ষা লিয়ে আমার কুনও কথা বলার অধিকার লায়। মুক্তি যখন ঘরেতে পড়েহে আর আমাকে বুলে বই কিনে দিতে আমি চুপ করি থাকিগো বাবু। টাকা কুথাকে পাব?’’ মুক্তির বাবা কথা বলে আর নিজেকে অসহায় ভাবে। ক্লাসঘরের দেওয়ালে টাঙানো ম্যাপ, শিক্ষা চার্টের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে সে।
উচ্চশিক্ষিত প্রবাসী বাঙালি শিবশঙ্কর বাবু হাল না ছেড়ে বলেন, ‘’মূর্মুভাই আপনার মেয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যেসব সাহায্য লাগে আমাদের সংস্থা সব ব্যবস্থা করবে। বাড়িতে বসে পড়তে চাইলে সে ব্যবস্থাও আমরা করব। আমরা বিনামূল্যে মুক্তির ফুটবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। এবং পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে দেব। আপনি দেখবেন আপনার মেয়ের কোনওরকম অসুবিধা হবে না।‘’ হতাশ মুক্তির বাবা আশাহীন চোখে শিবশঙ্করবাবুর চোখের দিকে চেয়ে থাকেন। এই প্রথম একজন আনপোড় আদিবাসি মানুষ শহুরে উচ্চ শিক্ষিত মানুষের চোখের দিকে তাকায়চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায়। তাঁকে বিশ্বাস করা যায় কিনা পরখ করে দেখে মুক্তির বাবাঠকতে ঠকতে আদিবাসি সমাজের মানুষজন আর কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। বিশ্বাস করতে পারে না।
শ্রীজা সংস্থার কর্ণধার শিবশঙ্করবাবু কথায়, আমার কাছে দ্বিতীয় একটি পরিকল্পনা ছিল ওদের জন্য। আমি একটি সাদা কাগজে আয়তক্ষেত্র আঁকলাম। এবং দু’প্রান্তে দুটো গোলপোস্ট এঁকে নিলাম। ১১টা ডট এবং ৪-২-৪ হিসেবে আরও ১০টা ডট দিলাম সাদা কাগজের আয়তক্ষেত্রে। মুক্তির বাবার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল। চনমন করে উঠল তার সমস্ত দেহমন। আমি ওদের বললাম, ‘’আপনারা মুক্তিকে ভালো ফুটবল খেলতে সাহায্য করতে পারেন। কি পারবেন না?’’
‘’হুগো, কিন্তুক কথা হোছে আমার মেয়া ৪-২-৪ ছকে খেলতে লাড়বে। আমি জানি ইটাই যে, আমার মেয়া ব্যাক পজিশনে খেললি পুরা পুরা ৯০ মিনিট লড়াই দিবেক।‘’ সে অতি উৎসাহের সঙ্গে কথা গুলি বলে।
‘’হ্যা অবশ্যই আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে সেই ব্যবস্থা করব। মুক্তি যাতে পেশাদারি ফুটবলে অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য ওর পেশাদার কোচিংয়ের ব্যবস্থা করবে এই সংস্থা। এছাড়া পুষ্টিযুক্ত খাবারের ব্যবস্থাও আমরাই করব। যাতে ও ৯০ মিনিট মাঠে ছুটে সারা মাঠ জুড়ে খেলতে পারে। ব্যাক পজিশন থেকে উঠে গিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে গোল করতে পারে।‘’ একজন মননশীল সমাজ সচেতন প্রকৃত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আধিকারিকের দায়িত্বে কথাগুলি বলেন ডঃ শিবশঙ্কর দাশগুপ্ত।
এই আলোচনার পরে শিবশঙ্করবাবু উপলব্ধি করলেন, ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’ সমাজের মা-বাবা তাঁদের ছেলেমেয়েদের দেখে, তাঁরা স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ব্যর্থ হচ্ছে। তাঁদের ছেলেমেয়েদের ব্যবহার মাঝে মাঝে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। তার কারণ সম্ভবত প্রজন্মের পর প্রজন্ম চরম দারিদ্র, হতাশা। অভাবের কারণে স্কুল কলেজে নিজেরা পড়তে পারেনি। ‘বাবু সমাজ’-এর আলো থেকে আজও তাঁরা বঞ্চিত। স্কুলছুট হয়ে ভাগ্যের কাছে জীবনকে সঁপে দিতে হয়েছে। ঋণের বোঝা চেপে আছে বংশ পরম্পরায়। ভারতে ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’ সামাজিকতায় বাবা-মায়েরা আহত হওয়ার কারণে নিজেদের সন্তানের বুনিয়াদি শিক্ষা বা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোনোরকম আশার আলো দেখতে ব্যর্থ হয় তাঁরা। তাই ভোকেশনাল শিক্ষা এঁদের প্রথম পছন্দের। আগে পরিবারে অর্থের যোগান করুক আদিবাসী সমাজের ছেলেমেয়েরা। তারপরে লেখাপড়া।
মুক্তিদের মতো একটি আদিবাসী পরিবার নয়, আরও কয়েকটি আদিবাসী পরিবারে ক্ষেত্র সমীক্ষা চালিয়ে ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নারসঃ এ শ্রীজা ইন্ডিয়া পারস্পেক্টিভ (First Generation Learners: A Shreeja India Perspective)’ বুঝতে পেরেছে আদিবাসী সমাজের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রাকৃতিক গঠন(সামজিক এবং পারিবারিক) এর কারণেই যে কোনও খেলাতে আগ্রহ বেশি। তাই একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও এরা গরীবের খেলা, বাঙালির সেরা খেলা ফুটবল খেলাকে বেছে নিচ্ছে। সেই কারণে মুক্তির মা-বাবা মেয়ের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁকে গ্র্যাজুয়েট করতে চায় না। ফুটবল খেলায় প্রশিক্ষিত করে পুলিশে চাকরির ব্যবস্থা করতে চাইছে। এটা হলে হয়ত আর্থ-সামাজিকভাবে এরা সমাজের মূলস্রোতে উঠে আস্তে পারে।
ভারতে ছেলেদের ফুটবল দলের বর্তমান অবস্থান কোথায়? বিংশ শতাব্দীর শেষের দশক (১৯৯৩ সাল) থেকে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভারতের ফুটবল দলটির যে অবস্থান আমরা দেখি সেটা খুব কিছু আশাব্যঞ্জক নয়। বর্তমান সময়ে বিশ্ব ফুটবলে মাত্র চারবার ভারতীয় পুরুষ ফুটবল দল ফিফা তালিকায় ১০০-র নীচে আস্তে পেরেছিল। সালগুলি হচ্ছে ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০১৭ এবং ২০১৮তে। উল্লেখ করা যায় একমাত্র ১৯৯৬ সালে বিশ্বমানে ৯৪তম স্থানে উঠে আস্তে পেরেছিল ভারতীয় পুরুষ ফুটবল দল। এটাই এ পর্যন্ত সেরা অবস্থান। পাশাপাশি ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের অবস্থান্টা একবার দেখা যাক। সম্প্রতি ভারতীয় মহিলা ফুটবল দল চারধাপ এগিয়ে ফিফা তালিকায় বিশ্ব ফুটবলে ৫৬ নম্বরে উঠে এসেছে। এশিয়ায় ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের স্থান ১৩ নম্বরে।
সেদিন মুক্তির মা আশা আরও একটি কথা বলেন, ‘’নেখাপড়া শিখার লেগে আমাদের মেয়াকে স্কুলে পাঠাতে হবেক। ইটাই ছিল আহমাদের ভাবলায়। কিন্তু এখুন ভেবি দেখলুম উয়ার ভবিষ্যৎ আমদেরকেই ভাবতে হবেক। উয়ার যেন আমাদের মতো জীবন না হয়।’’
ভারতের বেশিরভাগ গ্রামের স্কুল কতৃপক্ষ এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার কাজ আদিবাসী সমাজে এখনও বেশ কঠিন। এই সমাজের ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে এসে কলেজ পর্যন্ত পড়তে বলাটাও ওদের কাছে অনেক সময় অপরাধ বলে মনে হয়। কারণ বংশ পরম্পরায় এই সমাজের প্রতিটি পরিবার মহাজনী ঋণের ফাঁদে আটকে আছে। এই ফাঁদ কেটে বেড়নোর রাস্তা যে উচ্চ শিক্ষা এটা ওরা বুঝতে চায় না। স্কুলের পরিবেশ আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের কাছে আজও বেমানান মনে হয়। তার অন্যতম কারণ পারিবারিক অশান্তি, বংশ পরম্পরায় দারিদ্র, সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ। গ্রামের মোড়ল, জোতদার পরিবারের ছেলেমেয়েদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওদের যোজন যোজন দূরত্ব। ওদের কাছে এইসব কারণগুলি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেএক অলঙ্ঘন প্রাচীরের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। এবং স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। ফলে একটা শুন্যতা গড়ে ওঠে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের মধ্যে। আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে গিয়ে সচেতন শিক্ষকরাও বুঝতে পারেন, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় এরা আজও ‘অপর’ হয়ে আছেউচ্চ শিক্ষাই যে ‘অস্তরাগ’ দেখাতে পারে এটা বোঝাতেই অনেক অনেক পথ পেরতে হবে হয়ত ভারতীয় প্রত্যন্ত গ্রামের সমাজ সচেতন শিক্ষকদের।
গরিব মানুষকে শস্তায় চাল-গম সরবরাহ করার বেশ কিছু প্রকল্প ইতিমধ্যে আমাদের দেশে চালু হয়েছে। উল্লেখ করা যাক সেই সব প্রকল্প। ‘অন্ত্যোদয়’ প্রকল্পে দারিদ্রসীমা রেখার নীচে যারা বাস করেন, বিপিএল সম্প্রদায়ভুক্ত যেসব পরিবার। সেই গোষ্ঠীভুক্ত প্রতি পরিবারকে ৩ টাকা কেজি দরে চাল এবং ২ টাকা কেজি দরে গম প্রতি মাসে ৩৫ কেজি করে দেওয়ার কথা আইনে বলা আছে। মিড-ডে মিল প্রকল্পও অনেক শিশুকে বাঁচিয়ে রাখছে এবং স্কুলে টেনে আনছে। তাছাড়াও আছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য ‘অন্নপূর্ণা’ প্রকল্প। ইউপিএ সরকার ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’ এনে উল্লেখিত সমস্ত প্রকল্পগুলিকে একটি অভিন্ন আইনের আওতায় গ্রথিত করেছে। এর ফলে এখন বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারগুলি আইনত এইসব সুযোগগুলি দাবি করতে পারে। কিন্তু এইসব সরাকারি প্রকল্পের পণ্যসামগ্রী এবং অনুদান প্রত্যন্ত গ্রামে কজন গরিব পরিবারের কাছে পৌঁছায়? স্থানীয় রাজনৈতিক মোড়ল মাতব্বরদের মাহাজনী বৌদ্ধিক কৌশলে পণ্যসামগ্রী চোরা পথে চলে যায় খোলা বাজারে।
পাশাপাশি আছে আদিবাসী সমাজের আদিম বিশ্বাস বা মূল্যবোধ। সমাজ বিঞ্জানীরা সাঁওতাল সমাজকে এক ‘engalitarian’ বা সর্বসমতাবাদী সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সমাজ বিঞ্জানীরা আরও দাবি করছেন,  তথাকথিত হিন্দু বা মুসলিম সমাজের তুলনায় এরা অনেকটাই সমতাবাদী। লিঙ্গ বৈষম্য অনেকটাই কম। পঞ্চায়েত পরিচালনায় যেমন সাঁওতাল সমাজের নারীর কোনও ভূমিকা নেই। আবার পরবের দিন নির্ধারণ ক্ষমতা একান্ত-ভাবেই থাকে পুরুষের হাতে। এমনকি পরবের প্রথম দিনের পুজো দেখাটাও মেয়েদের পক্ষে নিষিদ্ধ। বিশ্বায়ন উত্তর ‘পোস্ট ট্রুথ’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি রাজ্যের বীরভূম জেলার ছোটনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী গ্রামের যে উপকথার খোঁজ আমরা পেলাম। তার থেকে এটা বলতেই হয় মুক্তি মূর্মুর স্কুল শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজন তার বাবা-মায়ের প্রেরণা। তার বাবা ছিলেন বীরভূম জেলা ফুটবল দলের নিয়মিত সদস্য। কিন্তু ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে তিনি সামাজিক সম্মান পাননি। সেই অপমানের কথা মুক্তির বাবামায়ের মনে আছে। তাই একটা জেদ তাঁদের মধ্যে কাজ করছে। তাঁদের সম্প্রদায়কে, সমাজকে দেখিয়ে দেওয়া তাঁদের মেয়ে ফুটবল খেলে পুলিশে চাকরি পেয়েছে। গ্র্যাজুয়েট হয়ে নয় ‘ফুটবল’ খেলোয়াড় হয়ে সরকারি চাকরি পেয়েছে। তাঁদের সমাজকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করছে সে।
 মুক্তি মূর্মুর অভিঞ্জতা আমাদের দেখিয়ে দিল ভারতে ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নাস’-রা শিক্ষাগত, মানসিক, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়ের কাউন্সিলিংয়ের যেমন প্রয়োজন আছে। সমাজকর্মী, সরকারি আধিকারিকদের দায় এবং দায়িত্বের মধ্য পরে ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার সমাজের বাবামাকে সচেতন করে তোলার। কারণ তাঁদের সাহায্য ছাড়া স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে ফেরানো অসম্ভব। কিন্তু আবার এটাও ঠিক ক্রীড়া নির্ভর শিক্ষার কথা বললে মুক্তিকে ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’ আদৌ কি বলা যায়? এঁদের বাবা-মায়েরা মেয়েদের ফুটবল খেলতেই বেশি উৎসাহ দিয়ে থাকে। সেটা অর্থ উপার্জনের কারণে হোক অথবা সমাজে সম্মান প্রতিপত্তি জাহির করার জন্যই হোক। এই আখ্যান কি ভারতের মা-বাবাদের অশিক্ষার ছবি সামনে আনে বলে মনে হয়না? তবু বলব ফাইট কোনি, ফাইট। ফাইট মুক্তি ফাইট।
                                              (ঋণঃ ফার্স্ট জেনারেশন লার্নারসঃ এ শ্রীজা ইন্ডিয়া পারস্পেক্টিভ)
 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?