বৃহত্তর গণতন্ত্রের বিতর্ক চতুর্থস্তম্ভের মঞ্চে





দীপেন্দু চৌধুরী
আমাদের রাজ্যে গত কয়েক দশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কাদের সঙ্গে আছে? দলগতভাবে কংগ্রেস কি দাবি করতে পারবে সংখ্যালঘুরা কংগ্রেসের সঙ্গে আছে? প্রশ্নটা এসেছিল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের কাছে। ২৪ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাব লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজন করেছিল ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানের। তিনদিনে কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস চারটে দলের পক্ষ থেকে চারজন নেতা বক্তব্য রাখেন। এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তাঁরাপ্রথম দিন ২৪ এপ্রিল ছিল কংগ্রেসের জন্য বরাদ্দ। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বলেন, ‘হ্যা আমাদের দুর্বলতা আছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তবে তাঁরা আবার আমাদের দলে ফিরে আসছে। আলোচনা করলে বলতে হয় ‘সাচার কমিটি’ কারা করেছিল? বিজেপি আমাদের আক্রমণ করে বলে আমাদের দল সংখ্যালঘুদের গুরুত্ব দিয়ে থাকে বেশি।’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির টেনে আনা সাচার কমিটির প্রসঙ্গ ধরে যদি আমরা একবার ফিরে দেখি। তাহলে দেখব ১৯৯০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু সেই সময় রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণ চালু করতে আগ্রহী ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার সরকারি চাকরিতে ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার আগেই দেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকার যেমন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং কেরালা রাজ্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছিলএ ছাড়া রাজ্য সরকারের পরিচালনাধীন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে নানান স্তরে সংরক্ষণ চালু করেছিল ওই সব রাজ্যএই সব রাজ্যের মধ্যে কয়েকটি রাজ্য মুসলমানদেরও ওবিসি হিসাবে গণ্য করে তাঁদের জন্য সংরক্ষণ চালু করেছিল। এরপরেই তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার নড়েচড়ে বসে। প্রথমে ওবিসি-দের জন্য ৫ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়া চালু করে। পরে সেটা বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হয়। যদিও তারপরেও রাজ্যের সংখ্যালঘুদের চাপা ক্ষোভ থেকে যায়। বামফ্রন্টের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ধ্বস নামে। ২০০৬ সালে যে সাচার কমিটির রিপোর্ট ইউপিএ সরকারের তত্বাবধনে প্রকাশ করা হয়, তাতে বলা হয়েছে মুসলমানেরা মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। দেশের সংগঠিত ক্ষেত্র বলতে যা বোঝায় যেমন সরকারি দপ্তর, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা এবং বড় বড় কর্পোরেট সংস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মরত মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মচারীদের মধ্যে সমীক্ষা করে সাচার কমিটি বলে, শহর এলাকায় উচ্চবর্ণ হিন্দুদের ২৮.৬ শতাংশ, তপসিলি জাতি- জনজাতিদের ২১.৫ শতাংশ এবং ওবিসি-দের ১৭.৮ শতাংশ উল্লেখিত ক্ষেত্রে কর্মরত। কিন্তু উল্টোদিকে মুসলমানদের মধ্যে মাত্র ৭.৯ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে। ২০০১ সালের লোকগণনায় ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৭৮ লক্ষ। এই হিসেব দেখাচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩.৪ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আমাদের রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ বসবাস করেন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়া বাদ দিলে ভারতে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস। আমাদের দেশের এই বিশাল বিপুল জনগোষ্ঠী যদি ধারাবাহিকভাবে স্থায়ী দারিদ্র, অশিক্ষার কবলে থেকে যান তা হলে তাঁরা একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উন্নয়নে অংশ নেবে কি ভাবে? এই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মানব-সম্পদ রয়েছে তাঁকে ব্যবহার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের সমাজের মূল ধারার নানানক্ষেত্রে অংশ নেওয়ার অধিকারই থাকে না।
কলকাতা প্রেস ক্লাব আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে এই বিতর্ককে আরও সামনে নিয়ে এসেছে। ২৫ এপ্রিল বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষকেও ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান’ এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল এবং ভারতে দলিত, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রসঙ্গ তোলেন সাংবাদিকরা। দিলীপ ঘোষ দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অনেক মুসলিম শিল্পপতি বন্ধু আছেন। এবং তিনি আরও জানান, ভারতে কতজন মুসলিম দেশ তথা আমাদের রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন সেই হিসেব আমাকে দিন। আমি আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটিকে পাঠিয়ে দেব। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলমানদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধার কথা বলছেন। ‘মুসলিম তোষণ’ করার নামে তৃণমূল সরকার কিছুই করেনি।
দিলীপ ঘোষের বক্তব্য অসার হিসেবে দাবি করেছে দিল্লীর একটি নিউজ পোর্টাল। ওই পোর্টালের দাবি, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় ইমাম ১০ হাজার মুসলিম পরিবারকে চিঠি লিখে আবেদন করেছেন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য, তাঁদের আবেদনে ‘ফ্যাসিস্ট’ শক্তিকে পরাস্ত করতে রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলকে বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। ওই সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসকে এই মুহূর্তে মুসলিমরা বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য দল হিসেবে দেখছে। ২৭ এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাবের ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র। সাংবাকিরা তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, রাস্তায় কাদের দেখা যাচ্ছে? স্বাধীনতার পরে বামপন্থীরা আমরা সবথেকে বেশি আক্রান্ত। তবু আমরাই পথে আছি। সংখ্যালঘুরা মুখ ফিরিয়ে রাখলেও একদিন তাঁরা ফিরে আসবে। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যবাবুর কাছে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বি টি রণদিভে নব্বইয়ের দশকে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন বামপন্থীদের উপরি কাঠামো (সুপার স্ট্রাকচার) যদি ভেঙে যায় তাহলে মূল সংগঠন অর্থাৎ পার্টি সংগঠনে তাঁর প্রভাব পড়বে। উত্তরে সূর্যবাবু জানান বামপন্থীরা সারা বিশ্বে আক্রান্ত। আমারা আমাদের রাজ্যে যেমন আক্রান্ত সারা দেশে আমরা আক্রান্ত। এই আক্রমণকে আমরা নেতি বাচক হিসেবে দেখি না। আমাদের নীতিগত বিচ্যুতি নেই। আমরা বর্তমান পরিস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।
২৭ এপ্রিল একইদিনে কলকাতায় চতুর্থস্তম্ভের মঞ্চে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিজেপিকে আক্রমণ করে বলেন, এটা ক্ষমতায়নের নির্বাচন নয়। সমগ্রজাতি কোনদিকে চলবে? ভারতের সমস্ত জাতি একসঙ্গে থাকতে পারবে কি? ঐক্যবদ্ধ ভারতের চরিত্র থাকবে কি থাকবে না? অখন্ড ভারতের চরিত্র থাকবেতো? উন্নত ভারত বলতে যারা ব্যর্থ হয়েছে সেই শক্তিকে পরাজয় করা হবে কি হবে না? এতগুলি বিষয়কে মাথায় রেখে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে আমরা লড়াই করছি। আমরা বাংলা থেকে উঠে আসা ভারতের একটি রাজনৈতিক শক্তি। গত কয়েক বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে উন্নয়ন করেছেন সেটা আর কোন রাজ্য করতে পেরেছে? দেশের অখন্ডতাকে রক্ষা করাই আমাদের দলের অন্যতম নীতি। পার্থবাবুর কথার সূত্র ধরে ফিরে যেতে হয় মূল বিষয়ে। ২৩ মে আমরা বুঝতে পারব ভারতের তথা রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় কোন দলের উপর আস্থা রাখতে পারলেন অথবা পারছেন। দেশের অন্যতম একটি সম্প্রদায়ের মানুষ পিছিয়ে থাকলে দেশের অগ্রগতি ব্যহত হয়। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও সংখ্যালঘুদের ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ ছাড়া আর কিছু আমরা ভাবতে পারছি না কেন? একই প্রশ্ন বছরের পর বছর উঠছে। আধা ঔপনিবেশিক-আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভেঙে ভারত উন্নত রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি নীরব উপেক্ষা রাষ্ট্রনায়কদের কোন উন্নত মঞ্চে বসতে সাহায্য করবে?                                 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?