এখনও কি সহজ নয় সহনাগরিকের পথে হাঁটা



দীপেন্দু চৌধুরী
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় পুরুষের অহঙ্কার তথা দাম্ভিকতা এবং আধিপত্যবাদ নারী সত্তাকে অবদমন করে রেখেছে। সমাজ বিকাশের নানা ধাপ পার হয়ে আসার পরেও বর্তমান সময়েও বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে তার প্রকাশ ঘটতে আজও আমরা দেখছি। বর্তমান সময়ে ‘জেন্ডার বায়াস’-এর আলোচনার ক্ষেত্রে মেয়েদের দিক থেকে যে সব দাবিগুলি উঠে আসছে তার বেশিরভাগটাই প্যাট্রিয়ার্কির বিরুদ্ধে এবং পৌরুষয়েতার বিরুদ্ধে। আমেরিকায় নারী স্বাধীনতার দাবিতে যে আন্দোলন ১৯৬৮-৭০ সালে ‘ফ্রিডম ট্রাশ ক্যান’(Freedom trash can) নামে আরম্ভ হয়েছিল, সেই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল এক জন মহিলা ঘর-গৃহস্থালির থেকে বাইরে বেরিয়ে আস্তে চায় ‘কেরিয়ার উইমেন’(Career women) হয়ে ওঠার দাবিতে তাঁরা সংগঠিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনের আরও একটা উজ্জ্বল দিক ছিল পুরুষের পৌরুষেয়তায় আঘাত করা। ফ্রিডম ট্রাশ ক্যান আন্দোলনের মুল উদ্দেশ্য ছিল, এক জন পুরুষ যেসব কাজ করতে পারে একজন নারীও সেই কাজ করতে পারে। কাজের জায়গায় সমান বেতন, সম বিভাগ সমান অধিকার এই তিনটে দাবিতে থেমে থাকলে হবে না। ওমেন্স লিব- আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত্তি এমনটাই ছিল। এই আন্দোলনের আগে উন্নত বিশ্বে, তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের পরে নারী ভোটাধিকার পায় ১৯২০ সালে। যদিও ব্রিটেনে ১৯১৯ সালে নারী ভোটাধিকার পায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দুটি শর্ত ছিল। এক সম্পত্তির মালিক হতে হবে এবং দু’ই নারীকে ভোটাধিকার পেতে হলে গ্র্যাজুয়েট হতে হবে।      
আমেরিকার নারী আন্দোলনের পরে কেটে গেছে প্রায় পাঁচটা দশক আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা কি? মাত্র দেড় দু’মাস আগের ঘটনা। পর পর মেয়ের হওয়ার জন্য মেয়েগুলোকে খুন করে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি সংস্কৃতি সচেতন, সভ্যতা সচেতন রাজ্যের হাওড়া জেলার লিলুয়ার ঘটনা। সংবাদ মাধ্যমে পড়তে পড়তে শিউরে উঠতে হয়। অত্যন্ত সাধারণ একটি পরিবারে পর পর মেয়ের হওয়ার জন্য মেয়েগুলোকে খুন করে দেওয়া হচ্ছে? রাজ্যের আরও একটি ছবি সদ্যোজাতদের মাতৃদুগ্ধ পান করানোয় অনেকটাই পিছিয়ে আছি আমরা। ‘ন্যাশন্যাল হেলথ প্রোফাইল, ২০১৮’-র রিপোর্ট বলছে এ রাজ্যের ৫৩ শতাংশ শিশুকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে স্তন্যপান করানো হয় না। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে স্তন্যপান না করালে কি কি সমস্যা হতে পারে? এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র রিপোর্ট সতর্ক করেছে। এটা যদি আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক আধা পুঁজিবাদী ভারতের ছবি হয় পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে দেখুন।
কি দেখতে পাবেন? সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ দৈনিক দাবি করেছে লন্ডন, ইয়র্কশায়ার, এসেক্স, ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের অনেক পরিবারে কিশোরী মেয়েদের স্তন তৈরি হওয়ার সময় ‘ব্রেস্ট আইরনিং’ করা হয়। এই আইরনিংয়ের কারণে স্তন বৃদ্ধি হবে না। ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা রুখতেই এই আদিম প্রথা। ব্রিটেনের ওইসব অঞ্চলের আক্রান্ত কিশোরীরা সকলেই মূলত আফ্রিকীয় বংশদ্ভূত। আফ্রিকার ক্যামেরুনে শুরু হয়েছিল এই আদিম প্রথা। কন্যা সন্তানকে যৌন হেনস্থা থেকে বাঁচাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মা, মাসি, ঠাকুরমারা এই কাজ করতেন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান মার্গারেট নিউজেউইরার দাবি করেছেন ব্রিটেনে অন্তত ১০০০ মহিলা এবং কিশোরী এই প্রথার শিকার। রাষ্ট্রপুঞ্জের দাবি, সংস্কার অথবা পারিবারিক সামাজিক প্রথার নামে বিশ্বে যোনিচ্ছেদের মতো যে ধরনের লিঙ্গ-সম্পর্কিত হিংসা আমারা দেখি তার মধ্যে এটি অন্যতম।
দু’টি উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নাগরিকদের তুলনা আমরা করতে চাইলাম। ভারতের দিকে আবার ফিরে তাকালে দেখব ভারতের শ্রমজীবী জনতার ৯৪ শতাংশ কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ভারতে নারীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ গৃহস্থালির কাজ করেন। অর্থাৎ গৃহশ্রম, এই শ্রম থেকে কোনওরকম অর্থ উপার্জন হয় না। সম্প্রতি গুগুল ইন্ডিয়ার উচ্চ পদস্থ আধিকারিক স্বপ্না চাঢঢা একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ভারতে মাত্র এক তৃতীয়াংশ মহিলা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এই তথ্য বলছে, অন্যান্য উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অত্যন্ত নীচের দিকে ভারতের অবস্থান। ভারতের গ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ১০ জন মহিলার মধ্যে মাত্র একজন ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে সক্ষম। পাশাপাশি তথ্য বলছে সাবালিকা মহিলাদের অর্ধেক আর শহরের এক-পঞ্চমাংশ ঘরের বাইরে কাজ করেন। এঁদের বিরাট অংশটাই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ভারতে নারীশ্রমিক আছেন সারে ১৪ কোটি। নারীদের স্বশক্তিকরণ কি করা সম্ভব হয়েছে? আইন সম্পর্কে অসংগঠিত অথবা সংগঠিত ক্ষেত্রের কত শতাংশ মহিলা সচেতন? পারিবারিক হিংসা আইন, যৌন হেনস্থা বিরোধী আইন বিষয়েও আমাদের দেশের এবং আমাদের  রাজ্যের মেয়েরা কতটা সচেতন?  
ভারতের নারীস্বশক্তিকরণ-এর কাজ ভারতে প্রথম শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধির আমলে। তিনি পুরসভা এবং গ্রাম পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সংসদে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের দাবি তোলেন ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধি। ইউপিএ সরকারের এই বিলকে সমর্থন করে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল কংগ্রেস। আরও একটি উজ্জ্বল উদাহারণ, আজ থেকে ৪ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হওয়া ‘’কন্যাশ্রী প্রকল্প’’। প্রকল্পটির রূপকার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রকল্পের মূল উদ্দ্যেশ্য বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, স্কুলছুট আটকানো, নারীশিক্ষার বিষয়ে সচেতন করা ইত্যাদি। রাজ্যের এই প্রকল্পটি ২০১৭ সালে রাষ্ট্রসংঘের জন পরিষেবায় প্রথম স্থান পেয়েছে। ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প রাজ্য সরকারের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত বছর থেকে রাজ্য সরকার আরও একটি নতুন প্রকল্প এনেছে। প্রকল্পের নাম ‘রূপশ্রী’। এই প্রকল্পে রাজ্যের দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা ১৮ বছর বয়স হলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা করে পাবে, তাঁদের উচ্চ শিক্ষা এবং বিয়ের জন্য। রাজ্য সরকারের ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পও সম্প্রতি রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। গৃহাভ্যন্তরের বন্দীজীবন থেকে বাইরে বেরিয়ে আস্তে চাইছে শহর গ্রামের শিক্ষিত এবং সাধারণ নারীরা। সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ করে সমতা এবং মুক্তির পথে আরও একধাপ এগতে চাইছে ভারত সহ আধুনিক বিশ্বের নারী। একুশ শতাব্দীর উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে কি সহজ হবেনা পুরুষদের সঙ্গে নারীদের একসঙ্গে হাঁটার সহনাগরিকের পথ?            

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?