মুক্ত জানলার সংস্কৃতি মঞ্চ


দীপেন্দু চৌধুরী
লেখাটি কতটা নারী কেন্দ্রিক, কতটা পারিবারিক কেন্দ্রিক অথবা কতটা সামাজিক সেটা নির্ণয় এবং বিচার করার দায়িত্ব বৃহত্তর পাঠক সমাজের। সমাজব্যবস্থার বিবর্তনের কথা আমরা জানি। পুনরাল্লেখ না করলেও চলে। শ্রেণী ভিত্তিক নারী সমাজ যুগের পর যুগ ধরে স্থিরচিত্রের মতো নারীপুরুষ লিঙ্গভেদের একটি সাংস্কৃতিক ধারণা আমদের মধ্যে সেধিঁয়ে দিয়েছে। এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম এই বিষয়ে পুনরাবৃত্তি করেই থাকে। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্প, সংস্কৃতি, পারিবারিক এবং সামাজিকক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক আর্থ-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার একটা সুকৌশলী পদক্ষেপ আমাদের নজরে পড়ে। নারীর সতীত্ব, তার মাতৃত্ব, পুরুষের কাছে একজন নারীর আত্মসমর্পণ করা। এবং সার্বিকভাবে পুরুষের অধীনে নারীর মুক্তি ইত্যাদি বস্তাপচা সামন্ত্রতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা আমাদের মধ্যে আজও রয়েছে।
সম্প্রতি কলকাতায় দুটি ছবি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রথম ছবিটি ছিল বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের কবিতা ‘দুরারোগ্য আঙ্গুল’-এর চিত্রভাষ্য। ছবিটির পরিচালক শুভঙ্কর গুহ ১৬ লাইনের একটি কবিতাকে চিত্রনাট্যে ধরেছেন। ছবিটির নাম ‘তসল’।গল্পটি বাংলাদেশের একটি সাধারণ পরিবারের কিশোরী মেয়ের পারিবারিক হিংসার গল্প। কবিতার কাব্যিক শব্দের মতই ছবির ক্যামেরা আমাদের বাংলাদেশের একটি অজ গ্রামে নিয়ে যায়। সেই গ্রামের ‘তসল’ নামে একজন কিশোরী, বাবার বন্ধুর কাছে নিগৃহীত হয়সেই চেনা গল্প শুভঙ্করের পরিচালনায় ছবিটিতে আমরা দেখিঅচেনা চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং সুরের ব্যঞ্জনায়। প্রকৃতির আদুরে ছন্দে। তসলের খুব ইচ্ছে হয়েছিল ‘রাজবাড়ি’ দেখবে। কয়েক মাইল দূরের গ্রামে সুদৃশ্য এক রাজবাড়ি। তসলকে কেউ অত দূরের গ্রামে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। বাবার বন্ধু তথা গ্রামের এক মোড়ল রাজবাড়ি দেখাতে নিয়ে যায় তসলকে।  মারবেল পাথর দিয়ে তৈরি রাজবাড়ির সাদা পাথরের ঘরে  কিশোরী তসলকে আত্মমর্পণ করতে হয়। কবি তসলিমার কবিতার গোঙানো শব্দ গদ্য হয়ে আমাদের সামনে আছড়ে পড়ে। 
রাজবাড়ি দেখানোর অছিলায় কিশোরী তসলকে হাসি মুখে নিয়ে যায় একজন মধ্য পঞ্চাশের পুরুষ। তারপর পরিচালকের গদ্যের ক্যামেরা নারীর যন্ত্রণা হয়ে ‘তফাৎ’ যাও বলে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে। ২০১৩ সালে তৈরি ছবিটি ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন শহরে দেখানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি ‘ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ ছবিটি দেখানো হয়েছে।  কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছে ‘তসল’ ছবিটি। শুভঙ্কর নিজে নাটকের লোক। ছবি করছেন দীর্ঘদিন। কয়েকটি তথ্যচিত্রও করেছেন। তসল ছবির পরিচালক শুভঙ্কর গুহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নতুন করে তৈরি করছেন। সেখানেও এক কিশোরীর গল্প।
পরের ছবিটি দেখলাম তরুণ প্রজন্মের পরিচালক দেবলীনা মজুমদারের ছবি। তিনি চিত্রনাট্য বেছে নিয়েছেন ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর প্রেক্ষাপটে। বাংলার বর্ধমান জেলার একটি গ্রামের দু’জন সমকামী নারীকে কেন্দ্রে রেখেপরিবার এবং সমাজের মূলধারার মানুষের কাছে প্রত্যাখান পেলেও তাঁরা হেরে যেতে চায়নি। নিজদের লড়াই নিজেরাই করে। দু’জন যৌবনউত্তীর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক নারী। তাঁরা স্বাধীন হতে চায়। সামাজিক স্বীকৃতি চায়। ছবির গল্প আমাদের কাছে চেনা। দর্শকরা দেবলীনার কাছে পেয়েছে ক্যামেরার ভাষা। কারণ দেবলীনা নিজে আলোকচিত্র শিল্পী। কলকাতার একটি প্রথমশ্রেণির দৈনিক সংবাদপত্রে বেশ কিছুদিন চিত্রসাংবাদিক হিসেবে কাজের অভিঞ্জতা আছে তারতাই এই ছবিটি মুখোশের আড়ালে মানুষের লোভ, জিঘাংসা, স্বার্থপরতা, আবেগ, মনন প্রভৃতির এক সমন্বয় হয়ে উঠেছে নতুনদের মধ্যে চিত্রপরিচালক হিসেবে দেবলীনার যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি আছে। তবে ছবি তৈরির বিষয়ের ক্ষেত্রে আরও মনযোগ দাবি করে। সিনেমা বলার ভাষা বুঝলেই ছবি চিরন্তন হয় না। মনন আমাদের গভীরে যেতে আহ্বান করে। পরিচালক দেবলীনাকে উপদেশ দেওয়া আমার কাজ নয়। আমি দর্শক হিসেবে এই বক্তব্য বলতে চাইছি। আমরা সময়ের অপেক্ষায় থাকব। দেবলীনা সামাজিক নতুন বিষয়ে তার দর্শন, চিন্তা, কলম, এবং ক্যামেরার চোখে দর্শকদের নতুন ছবি উপহার দেবেন।      
ছবি দু’টি দেখানোর আয়োজন করেছিল ‘ওপেন উইনডো’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান শ্রী জানালেন, তাঁদের উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মের শিল্পী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক এঁদের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। এই মঞ্চে খোলা মনে সবাই আলোচনা করুক। যারা ভুল করে এমন সৃষ্টিশীল মানুষদের চাইছেন খোলা জানলার কর্মকর্তারাবাংলা তথা কলকাতার রকের আড্ডাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন তাঁরা। শহর থেকে দূরে গ্রামগঞ্জের খোলা জানলার কাছেও যেতে আগ্রহী শ্রী এবং তার পার্টনার সুচন্দ্রা।
শুভঙ্কর গুহের ছবির বিষয়কে ধরে এগলে ভারতীয় উপমহাদেশে পারিবারিক হিংসা একটি অন্যতম সমস্যা। গত কয়েক দশকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই সমস্যা নিয়ে কাজ করছেভারতে ‘ফোর্ড ফাউন্ডেশন’-এর মানবাধিকার এবং সামাজিক বিচার বিভাগ নতুন একটি উদ্যোগ শুরু করেছে। গ্রাম শহরের মেয়েদের সচেতন করে তুলতে। এই উদ্যোগের পোশাকি নাম ‘বেল বাজাও’। ‘পুতুল নাচ’-এর মতো গ্রাম্য লোকশিল্পের মাধ্যমে প্রচার কর্মসূচীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটিগ্রামের স্কুল, শহরের কলেজ, স্কুলে নারী সমস্যা এবং পারিবারিক হিংসা বিষয়ে কর্মশালার কায়োজন করছে এই সংস্থাটি। এইসব কর্মশালায় শুধুমাত্র নারীদের ডাকা হচ্ছে এমনটা নয়। বাড়ির পুরুষদেরও ডেকে নেওয়া হচ্ছে। ২০০৮ সাল থেকে এই উদ্যোগ শুরু করেছে বিশ্বখ্যাত সংগঠনটি। পারিবারিক হিংসাকে বিষয় করে এই সংস্থা একটি মিউজিক অ্যালবাম তৈরি করেছে। অ্যালবামটির নাম ‘মন কি মঞ্জীরেঃ অ্যান অ্যালবাম অব উইমেনস ড্রীমস’। ভিডিও ভ্যানের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ১৩০ মিলিয়ন মানুষকে মিউজিক অ্যালবামটি দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ১৩০ মিলিয়ন মানুষের কাছে প্রদর্শিত হয়েছে ‘বেল বাজাও’ নামে পারিবারিক হিংসা বিষয়ক মিউজিক অ্যালবামটি।
২০১৩ সাল থেকে কানাডা, চিন, পাকিস্তান এবং ভিয়েতনামে একইভাবে এই অ্যালবাম নিয়ে প্রচার করছে সংস্থাটি। সংস্থাটির প্রোগ্রাম অফিসার মল্লিকা দত্ত সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘’Bell Bajao! invites everyone to be part of the solution. Men have to be engaged and involved. In the past, most programs have focused on providing legal remedies to women who have been abused. Those are critical pieces, but we need to understand that we really are going to be able to shift cultural norms only if we work with men to challange the idea of what it means to be a man and engage men in becoming part of the solution.’’
আপামর বিশ্বের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, আধুনিক সভ্যতার দাবি করলেও নারী আজও মুক্তির জানলা খুঁজছে। পুরুষ শাসিত বেড়াজাল থেকে বাইরে আস্তে চাইছে। শহর আর গ্রামের মধ্যে বিস্তর ফারাক। নারী এবং পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া বৃহত্তম এই কাজ করা সম্ভব নয়। এটাই বলতে চেয়েছেন মল্লিকা।             

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?