তিনি ফিরলেন সামরিক পোশাকে নয় ভারতীয় হয়ে
দীপেন্দু চৌধুরী
কেউ বলছে ৫০ ঘণ্টা পর। কোনও কোনও সংবাদ মাধ্যম
লিখছে ৬০ ঘণ্টা পর। কিন্তু তিনি ঘরে ফিরলেন। ফিরলেন বীরের মতো। ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন
বর্তমান দেশে ফিরলেন। ভারতীয় সামরিক পোশাকে নয় অসামরিক পোশাকে। সাধারণ ভারতীয়ের
মতো। বীরের মর্যাদা নিয়ে তিনি ফিরলেন। পাকিস্তানের একটি যুদ্ধবিমানকে তাড়া করে
ধ্বংস করেন তিনি। পাকিস্তানের সেনারা অভিনন্দনের ‘মিগ’ বিমান গুলি করে নামায়। ২৭
ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনারা আটক করে অভিনন্দনকে। অভিনন্দনের ব্যক্তিগত
সাক্ষাৎকারের ভিডিও আমরা দেখেছি। পাকিস্তানের সেনা অফিসারের জেরায় তিনি বিচলিত
হননি। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে গেছেন। প্রাণের ঝুঁকি
নিয়েও। তারপর বিভিন্ন কূটনৈতিক স্তর, ধৈর্য এবং সময়ের মূল্যে উইং কমান্ডার দেশে
ফিরলেন। ভারত ‘ইন্ডিয়া’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। ভারতের জাতীয়তাবাদ নিয়ে কোনও
ভারতীয়ের আপত্তি থাকার কথ নয়। কেউ বা কারও দ্বিমত করার কথাও নয়। সেটা অভিনন্দন স্যারের
প্রত্যাবর্তনের দিন বোঝা গেছে। উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল। সারা ভারতে উৎসব উৎসব মেজাজ। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নব্য ‘জাতীয়তাবাদী’-এর সমর্থকরা দেশে অসময়ের
দেওয়ালি উদযাপন শুরু করে দিয়েছিল। মূহু মূহু বাজি ফাটছিল। আনন্দে আত্মহারা দেশের
আমজনতা। সারা দেশে উচ্চ মাধ্যমিক
পরীক্ষা চলছে। মাইক বাজানো, বাজি ফাটানো বন্ধের নির্দেশ আছে। কে কার কথা শুনছে। সারা দেশ ‘জাতীয়তাবাদী’ উৎসবে ব্যাস্ত। ভারতীয় বায়ুসেনার সাহসী সেনা অফিসার দেশে
ফিরবেন। এবং তিনি অবশেষে ফিরলেন।
১ মার্চ সকাল থেকে রাত নটা একুশ পর্যন্ত ওয়াঘা আটারি সীমান্তে চোখ রেখে
বসেছিল সমস্ত দেশ। পুলওয়ামায় জঙ্গি হানা, পরে-পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর
হানা। ১০০০ কিলো ওজনের বোমা ফেলা। কেন্দ্রের দাবি ৩০০ জন জঙ্গি মারা গিয়েছেন। ঠিক কত
জনের মৃত্যু হয়েছে? প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন তুলছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি।
প্রশ্ন তুলেছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। জঙ্গি হানায় সিআরপিএফের
৪৯ জন জওয়ানের মৃত্যুর বদলা ছিল বালাকোটে জঙ্গি ঘাঁটিতে ভারতীয় বায়ুসেনার পাল্টা
হামলা। এবং তারপর পাক সেনাদের এফ ১৬ বোমারু বিমান নিয়ে ভারতীয় সেনার উপর আক্রমণ।
সেই আক্রমণ পুরনো একটা মিগ নিয়ে তাড়া করে রুখে দিয়েছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার সাহসী
সেনা অফিসার অভিনন্দন। তিনি তার সামরিক কর্তব্য করেছেন। পুলওয়ামা কান্ডের পরে গোটা
বিষয়টা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি যেভাবে রাজনৈতিক মুনাফা তুলতে চাইছে, এটা
একটা ভয়ঙ্কর ঝোঁক। আমরা কি ধরে নেব ভারত সরকার তথা বিজেপি নেতৃত্ব ২০১৯-য়ের
লোকসভার ভোটের আগে এই রকম যুদ্ধ যুদ্ধ একটা জিগির চাইছিলেন। সম্প্রতি সংবাদ
মাধ্যমে এমনই দাবি করেছেন প্রাক্তন বিজেপি সঙ্গী, দক্ষিণ ভারতের নেতা পবন কল্যাণ। তিনি
দাবি করেছেন, দু’বছর আগেই বিজেপি বলেছিল ভোটের মুখে যুদ্ধ হবে।
ভারতের ক্যালেন্ডার
থেকে যেমন ২৬/১১ তারিখটা মুছে ফেলা সম্ভব নয় ঠিক তেমনি পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার
দিনটাও মুছে ফেলা সম্ভব হবে না। ভারতের সামরিক ইতিহাস মনে রাখবে অভিনন্দন
বর্তমানের সাহসী এবং দৃঢ়তার কথা। ঋজু ব্যক্তিত্বের শারীরিক ভঙ্গির কথা। সামরিক এবং
অসামরিক ব্যক্তিত্বের কথা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভোটের আগে
যুদ্ধ যুদ্ধ জিগির তোলা নিয়ে। উরি-র সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে তৈরি একটি ছবির বহুল
প্রচলিত একটি সংলাপ ‘হাউ ইজ দ্য জোশ?’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইদানিং বিভিন্ন
জনসভা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে গিয়ে বলছেন এই সংলাপটা। কেন? সেনা নিয়ে তিনি রাজনীতি
করছেন? সেনার আত্মত্যাগ কি রাজনীতির বিষয়? দিল্লিতে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও ২৬/১১ এর প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, ২৬/১১ হামলার পর বিজেপি
ভোটে ‘মজবুত’ সরকারের স্লোগান তুলেছিল। লোকসভা ভোটের আগে কোনও একটি জাতীয়তাবাদী দল
‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’-কে চাগিয়ে তুলতে বালাকোট, উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের ছবি
ছেপে পোস্টার প্রকাশ করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেই পোস্টারে দলীয় নেতার ছবিও
দেওয়া হতে পারে। ভোটের মুনাফা লুটতে সর্বভারতীয় সেই দলটি সব রকমের সুযোগের
সদ্ব্যবহার আগেও করেছে আবার করবে। রাহুল গাঁধি এই বিষয়টার বিরোধী। তিনি
ধারাবাহিকভাবে অভিযোগ করছেন জওয়ানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। কংগ্রেস
কর্মীদের তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন লড়াই চলছে সরকারকে আক্রমণ নয়। সেনা জওয়ানদের নিয়ে
রাজনীতি নয়।
ভারতীয় উপ মহাদেশে
কাশ্মীর নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে ছায়া যুদ্ধ চলছে। এই
সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক
বিশ্লেষকরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে মনে করতে চাইছেন। ইতিহাস বলছে তৎকালীন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ নিজেদের
কূটনৈতিক দ্বন্দ মেটাতে শান্তি আলোচনায় বসেন। কিন্তু সেই আলোচনা ব্যর্থ হয়। শুরু
হয় নতুন বিশ্বের ভারসাম্য। তথা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চ। সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক
জোসেফ স্তালিন এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান নিজেদের দ্বন্দকে একটি
ঠান্ডা যুদ্ধের কূটনীতি হিসেবে দেখতেন। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয়েছে। বার্লিন
দেওয়ালের পতন হয়েছে।
উদার অর্থনীতির বিশ্বে উত্তর বিশ্বায়ন সময়ে বিজেপি উন্নয়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে ভোটে
জিততে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ জিগির তুলতে চাইছে। গত পাঁচ বছরের প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক
ব্যর্থতাকে আড়াল করতে যুদ্ধের এই প্রেক্ষাপট নয়তো? ভারতের এই সঙ্কটকালে অত্যন্ত
প্রয়োজন বিরোধীদের ‘জাতীয় ফ্রন্ট’-এর ঐক্যবদ্ধ লড়াই। যেমনটা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসিত
ভারতে। কংগ্রেসের ১৯২৫ সালের ৭ম কংগ্রেসে গৃহীত নীতি এবং অনুসৃত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
এবং মূলনীতি, কৌশলকে সামনে রেখে জাতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস ভারতে একদিকে
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে।
পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের
বিরুদ্ধে দেশের সমস্ত বামপন্থী দল এবং গোষ্ঠীকে সঙ্গবদ্ধ করে তুলতে কংগ্রেস সচেষ্ট
ছিল পারাধীন ভারতে। জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস নামক জাতীয়তাবাদী দলটি এই
দায়িত্ব পালন করেছিল। একথাও সত্য রমা রোলাঁ- বারবুস-এর নেতৃত্বে
যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে ভারতে ব্যপক এবং সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনে সংগঠিত করতে
উদ্যোগি হয়েছিলেন কমিউনিস্ট এবং সোস্যালিস্টরা। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় যুদ্ধ এবং
ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন। গল্প উপন্যাস লিখেছেন। অন্যতম
তার ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের দু’ই চরিত্র নিখিলেশ এবং সন্দীপ। কবির সবথেকে বেশি
আক্ষেপ ছিল ফ্যসিস্তদের উন্নত সাম্রাজ্যলালসা এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মিত্র শক্তির
অনেক রাষ্ট্রনায়ক এগিয়ে না আসায়। তার দুঃখ ছিল সাধারণ মানুষের উপর অন্যায় যুদ্ধ
চাপিয়ে দেওয়ায়।
ভারতের এই সঙ্কট সময়ে
আমাদের সাধারণ নাগরিকদের একজোট হতে হবে।
বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন স্যারের মতো অসামরিক পোশাকে প্রতিবেশী
সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ ভারতীয়দের মিছিলে হাঁটতে হবে। গত পাঁচ বছরে
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের নোট বাতিল, অসময়ের জিএসটি
(বিতর্কে গব্বর সিং ট্যাক্স), ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে সমস্যা, কৃষকদের আত্মহত্যা,
এমজিএনরেগা (কর্ম নিশ্চয়তা প্রকল্প) খাতে অর্থ কমিয়ে দেওয়া, কর্মদিবস কমে যাওয়া,
বেকারদের কর্ম সংস্থানের সমস্যা সহ দেশ পরিচালনার ব্যর্থতার দায় সেনা জওয়ানরা কেন
নেবে? সেনা আধিকারিকরা কেন নেবে? সামরিক ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে অভিনন্দন বর্তমানের
সঙ্গে আমরাও স্লোগান তুলছি ভারত মাতা কি জয়।
Comments
Post a Comment