মানুষ গড়ার কারিগরেরা আজও পথে


দীপেন্দু চৌধুরী
শেষ পর্যন্ত রাজ্যের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরকে রাস্তায় নামতে হল। ২৬ মার্চ তাঁরা অনশনরত এসএসসি চাকরি-প্রার্থীদের সমর্থনে এবং রাজ্য সরকারের অমানবিক উদাসীনতার প্রতিবাদে কলকাতায় মিছিল করলনেতৃত্বে ছিলেন চিকিৎসক শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেন, কবি, লেখক সব্যসাচী দেব এবং শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার। মিছিলে মূলত যোগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ সহ আরও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। এপিডিআরের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবিলম্বে অনশনরত কর্মপ্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।
আমার মনে পড়ছে কিছুদিন আগে আমি প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে অনশনরত একজন চাকরি-প্রার্থী আমার পথ আটকে আমার সঙ্গে কথা বলেন। ভীষণ ক্লান্ত, শীর্ণ কন্ঠে ভদ্রলোক আমাকে আমার ব্লগে কিছু লেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তিনি আমার কাছে আরও বলেছিলেন, ‘’আপনি একটা সময় পিটিটিআই আন্দোলনের খবর করেছেন দায়িত্বের সঙ্গে। আজ আমাদের এই অনশন আন্দোলন নিয়ে কিছু লিখছেন না কেন?’’ আমি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিলাম। জটিলতা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। বলেছিলাম, আমরা জানি, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। আমি উল্লেখ করেছিলাম সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অনুসন্ধান’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ। সম্প্রতি আমি একটি সিনেমা দেখেছি। সিক্তা বিশ্বাস পরিচালনা করেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসন্ধান উপন্যাস অবলম্বনে সিক্তার ছবির নাম ‘পথের সন্ধানে’। অত্যন্ত আবেগ প্রবণ ছবি। প্রকৃতির নিবির ঘেরাটোপে একজন শিক্ষকের আত্মত্যাগ এই ছবির বিষয়। ছাত্রের জন্য শিক্ষক কি করতে পারেন তারই দলিল লিখে গেছেন পথের পাঁচালির লেখক। মানুষ গড়ার কারিগরদের নিয়ে আজ দু’কথা লিখতে চাইছি। যদিও শিক্ষা বিষয়ক লেখার যোগ্যতা আমার নেই।  
সংবাদে দেখলাম শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দিয়েছেন। ওই কমিটিতে স্কুলশিক্ষা দফতরের সচিব মণীশ জৈন, এসএসসি চেয়ারম্যান সৌমিত্র সরকার সহ পাঁচজন রয়েছেন। অনশনরত চাকরি-প্রার্থী আন্দোলনকারীদের দাবি, এসএসসি নিয়ম প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়েছে। কি অনিয়ম হয়েছে? অথবা হয়নিএই বিষয়টা রাজ্য শিক্ষাদপ্তর অনুসন্ধান করবে। আমদের বিষয় মানবিকপ্রথমত রাজ্যে সুপ্রশাসক, দক্ষ প্রশাসক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অনশন আন্দোলন এতদিন চলতে দিলেন কেন? অথবা চলতে দিচ্ছেন কেন? লোকসভা ভোটের আগে এমন একটা বিষয় বিরোধীরা লুফে নেবেই। এবং সেটাই হয়েছে। অনশনরত এসএসসি চাকরি-প্রাথীদের মঞ্চে বিরোধীদলের বিভিন্ন নেতা সহমর্মিতা জানাতে গেছেন। রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্য সরকার কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। এটা নিন্দুকদেরও বলতে হবে। ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প, সবুজ সাথী প্রকল্প এবং স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পেই বিষয়টা থেমে নেই। ‘রূপশ্রী’ প্রকল্পও যথেষ্ট প্রশংসা দাবি করে। প্রাথমিক স্কুলে বিনামূল্যে বই, জুতো এবং পোশাকের ব্যবস্থা রাজ্য সরকার করেছে। নগরকেন্দ্রিক স্কুলগুলি এই ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারলেও প্রশ্ন উঠছে গ্রামের স্কুলগুলি নিয়ে। শহরাঞ্চলে অনেক শিক্ষক যেতে চান। এবং থাকতেও চান। বিভিন্ন সুযোগ পাওয়া যায় এই কারণে। গ্রামের স্কুলগুলিতে কতজন শিক্ষক শিক্ষিকা যেতে আগ্রহী থাকেন? রাজ্যে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুল কতগুলি রয়েছে? সেই সব স্কুলের পরিকাঠামো কতটা উন্নত? ২০১২ সালের দু’টি সংস্থার রিপোর্ট উল্লেখ করতে চাইছি। একটি আইআইএম এবং দ্বিতীয়টি প্রতীচী ট্রাষ্ট। রিপোর্টে ছিল, বুনিয়াদি স্তরে মোটামুটি ৫৫, ০০০ স্কুলের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এই হিসেব মেলেনি। প্রতীচী ট্রাস্ট জেলা ভিত্তিক যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেই রিপোর্ট থেকে আমরা আরও বিস্তারিত গড়মিলের কথা জানতে পারি।
রাজীব গাঁন্ধি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মানবোন্নয়ন মন্ত্রক থেকে ‘দ্য চ্যালেঞ্জ অব এডুকেশন’ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়। এবং ব্যাপকভাবে সারাদেশে প্রচারও করা হয়। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বিতর্ক গড়ে তুলতে। যদিও প্রকাশিত ওই বইয়ের মাত্র কিছু অনুমোদিত অংশ তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করে। গত বছরও প্রতীচী ট্রাস্ট রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আরও একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরাও সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলির অপ্রতুল পরিকাঠামো নিয়ে ধারাবাহিক খবর করছেন। সেইসব খবর থেকে জানা যায় বেশিরভাগ স্কুলে পানীয় জল, শৌচাগারের কোনও ব্যবস্থাই নেই। এবং শিক্ষক সংখ্যা ছাত্র অনুপাতে অত্যন্ত কম। সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সাগরের একটি স্কুলের একজন শিক্ষিকার বদলি বিতর্কে এই বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়েছে। আরও একটি রিপোর্ট এই লেখায় উল্লেখ করা যায়। বামফ্রন্ট আমলে শিক্ষা সম্পর্কিত স্ট্যান্ডিং কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন সিপিএমের বিধায়ক পদ্মনিধি ধর। দ্বাদশ বিধানসভার শিক্ষা সম্পর্কিত স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি তার স্বাক্ষরিত রিপোর্টে লিখেছিলেন, যতগুলি স্কুল স্থাপনার প্রয়োজন তার জন্য জমিটাও পরবর্তী দশ বছরে সংগ্রহ করা যাবে না। আইআইএমের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, চারটি ক্লাশের জন্য যদি একজন করেও শিক্ষক দিতে হয় তা হলে বিদ্যমান স্কুলের দ্বিগুণেরও বেশি স্কুল স্থাপন করতে হবে।
প্রথমেই প্রশ্নটা আমরা তুলে দিয়েছি। ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে আবহমান সময় ধরে যে রাজনীতি চলছে, সেই বিষয়ে পোড় খাওয়া তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতটা উদাসীন কেন? প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন করলে বর্তমান সময়ে রাজ্যের পক্ষে সেটা হবে অত্যন্ত উব্দেগজনক। কলকাতায় থাকার কারণে গ্রামগঞ্জের স্কুলের দুরবস্থার কথা আমরা কতটা জানতে পারি? কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে  স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কর্মপ্রার্থীদের অনশন আজ ২৭ দিনে পড়ল। এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের যেমন প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে মানবিক দিকটা নিয়ে ভাববারও। এবং এটা মুখ্যমন্ত্রীকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আশু সমাধানের একটা রাস্তা খুঁজে পেতে।                                

(এই স্তম্ভে লেখাটি প্রকাশ হয়েছে ২৬ মার্চ। ২৭ মার্চ বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনশ্নের ২৮ত্ম দিনে অনশন মঞ্চে যান। ২৯ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার অনশন প্রত্যাহার করে নিলেন এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ। আপনি সুপ্রশাস্কের ভূমিকা নিয়েছেন। জুন মাসে আশা করা যায় যোগ্য কর্মপ্রার্থীরা নিয়োগপত্র হাতে পাবেন। মানুষ গড়ার কারিগরদেরও ভাবতে হবে, রাজনীতির চোরা গলিতে যেন পথ না হারিয়ে যায়।)   


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?