মানুষের দাবি মেনে জানে বাঁচতে হবে




দীপেন্দু চৌধুরী
লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধির এবারের প্রথম বাংলা সফর দিয়ে কংগ্রেসের প্রচার শুরু হয়ে গেছে। রাহুল গাঁধি বাংলায় তার নির্বাচনী সফরে ‘ভারসাম্য’-এর বক্তব্য রেখে গেলেন।  বাংলায় আসার আগে রাজ্যে বামেদের সঙ্গে ‘নির্বাচনী জোট’ গড়ে তোলার সবরকমের প্রচেষ্টা রাহুল গাঁধি চালিয়েছিলেন। দফায় দফায় দিল্লিতে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সিপিএমের গতবারের জেতা মুর্শিদাবাদ এবং  রায়গঞ্জ আসন ছেড়ে রাখতে বলেছিলেন তিনিএই মর্মে বামেদের সঙ্গে সমঝোতায় এগতে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাহুল গাঁধি। কিন্তু রাহুলের প্রথম নির্বাচনী বাংলা সফরের আগে বামদের সঙ্গে ‘নির্বাচনী জোট’ অথৈই জলে। বিজেপির বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরে ১৯৭৭ সালের ‘মডেল’-কে সামনে রেখে বিরোধী ঐক্যের একটা বাতাবরণ গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল। যে প্রচেষ্টার শুরুয়াত হয়েছিল কর্ণাটক নির্বাচনের আগে। এবং সেই প্রচেষ্টা সফলও হয়। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে একই প্রচেষ্টা কিছুদিন আগে পর্যন্তও জারি ছিল। সংবাদবুভুক্ষ মিডিয়া গত একমাস ছুটছিল রাতজাগা, দিনজাগা দু’টি দলের নেতাদের কাছে তবুও ‘জোট কুয়াশা’ ভাঙা যায়নি।
নির্বাচনী নির্ঘণ্ট জারি হতেই রাজ্যে রাজ্যে আসন ভাগাভাগির ধাক্কায় ‘ফেডারেল জোট’-এর গতি থমকে গেছে। প্রশ্ন উঠছে আমাদের বাংলায় বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়া নিয়ে। সাম্প্রতিক অতীতে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি বিরোধী জোট গড়ে কংগ্রেস এবং বামেরা রাজ্যে সফল হয়েছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কথা আমরা বলতে চাইছি।
এই সাফল্যকে সামনে রেখে দ্বিতীয় দফায় কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে সোমেন মিত্র ‘জোট প্রক্রিয়া’ শুরু করেছিলেনসোমেন মিত্র প্রথম থেকেই একটা কথা বলছেন আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কোনও রকম জোটে যাওয়া সম্ভব নয়। এবং সেই আত্মসম্মানকে সামনে রেখেই এই অসম জোট ভেস্তে যেতে বসেছে। যদিও কেউ কেউ বলছে বামদের তরফে আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল। সেই কারণে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট কংগ্রেসের জন্য চারটে আসন ছেড়ে রেখে ফ্রন্টের আন্তরিক প্রয়াসের বার্তা দিতে চেয়েছিল। বামেদের আরও অভিযোগ সেই প্রচেষ্টাও রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্ব পাঁচটি আসন দাবি করে ভেস্তে দিতে চাইছে। রাজনীতি সম্ভবনার শিল্প। এই লেখা পর্যন্ত নতুন করে জোটের কোনওরকম উদ্যোগ আমাদের নজরে আসেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপিকে আটকাতে কংগ্রেস সহ বিজেপি বিরোধী দলগুলির সঙ্গে সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতই বামপন্থী দলগুলির দায়িত্ব এবং কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। এই রাজনৈতিক ক্ষমতা কিভাবে দখল করা যায় সেই মত এবং পথ নিয়ে নানান বিতর্ক আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আরও অভিমত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের এই প্রশ্নে বামপন্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ধারা তথা দলের জন্ম হয়েছে। তাঁরা এটাও দাবি করছেন বামপন্থীদের মধ্যে প্রথমসারির এবং সবচেয়ে অগ্রগামী অংশও ভারতে অনেকগুলি গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত রয়েছে
১৯৬৪ সালে মতাদর্শগত কারণে সিপিআই ভেঙে বিপ্লবী যে দলটির জন্ম হয় সেই দলের নাম সিপিআইএম। ১৯৬৪ সালের  সিপিএমের গৃহীত কর্মসূচীর ১১২ নম্বর ধারায় অঙ্গরাজ্যে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, ‘’পার্টি যদি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যে জনগণের আশু সমস্যাবলী প্রশমনের এক বিনম্র কর্মসূচীতে অঙ্গীকারবদ্ধ কোন সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে, তাহলে সে নিশ্চয় সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে।‘’ অর্থাৎ দেশের একটি প্রথমসারির ‘সমাজ গণতান্ত্রিক’ দল হিসেবে এই দায়িত্ব খুব সঠিকভাবেই সিপিএমের উপর বর্তায়। স্বাধীন ভারতে সিপিএমের নেতৃত্বে এই ধরণের একাধিক সফল জোট এবং অংশগ্রহণের কথা ভারতের গণতান্ত্রিক মানুষের স্মরণে আছে। সিপিএমের ব্যাবহারিক অস্ত্রই আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব ২০১১ সালে কাজে লাগায়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট বিরোধী মোর্চা গঠন করে
বিজেপি বিরোধী বৃহত্তর জোট গড়ে তোলা নিয়ে সিপিএম দলে গত কয়েকটি পার্টি কংগ্রেসে বিতর্ক হয়েছে। এই বিতর্কে দু’টো লাইনের কথা আমরা অবগত আছি। একটি প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বে কেরল লাইনঅপরটি বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে বেঙ্গল লাইন অথবা দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক হরকিষণ সিং সুরজিতের পুরনো লাইন। সেটা হল সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে আটকাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে হবে। ২০১৫ সালের বিশাখাপত্তনম পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল সিপিএম নামক ভারতের সর্ববৃহৎ দলটির সমস্যা একাধিক। প্রতি তিন বছর অন্তর পার্টি কংগ্রেসে দলকে আন্দোলনের পথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও দল ব্যর্থ হয়েছে। সিপিএম দলের মাত্র ৬.৫% সদস্য রয়েছেন যাঁদের বয়স ২৫ বছরের নীচে। অর্থাৎ কালো চুলের সংখ্যা কম। রিপোর্টে আরও ছিল, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম সরকার এবং বাম দুর্গের পতনের আগেই জাতীয়স্তরে সিপিএমের অস্তিত্ব সঙ্কট শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের লোকসভায় ৯টি রাজ্য থেকে সিপিআই এবং সিপিএমের সাংসদ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে মাত্র তিনটি রাজ্যের কমিউনিস্টদের প্রতিনিধি সংসদে ছিল। কমিউনিস্টদের রক্তক্ষরণ সমানে চলছিল।  
এই পরিস্থিতিতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি লোকসভায় ১৯৯১ সালের মতো না হলেও আরও কয়েকটি রাজ্য থেকে বামপন্থীদের সাংসদ সংখ্যার হার বাড়াতে চাইছেন। কমরেড ইয়েচুরির লাইন মেনেই আমাদের রাজ্যে রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে বামেরা আশাবাদী ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হবে। আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। গত কয়েক বছরের সালতামামি ফিরে দেখা যাক। ২০১৪ সালে লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গে ২৬% ভোট পায় সিপিএম। বামেরা যৌথভাবে পায় ২৯.৭% ভোট। কংগ্রেস পায় ১২% ভোট। বিতর্কে ৯.৫৮%। ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ২১১ টি আসন দখল করে দুই তৃতীয়াংশ ভোট পায়। মোট আসন ২৯৫। কংগ্রেস ৪৪ টি আসন পেয়ে দ্বিতীয়স্থানে উঠে আসে। এবং বিরোধী দলের মর্যাদা দাবি করে। সিপিএম ২৬টি আসন পায়। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট শতাংশ হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস ৪৪% ভোট পায়সিপিএম পেয়েছিল ১৯.৭% ভোট। কংগ্রেসের ঝুলিতে আসে ১২.৩% ভোট। সেখানে বিজেপি নেমে আসে ১০.২ শতাংশে। যদিও পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে বিজেপি দ্বিতীয়স্থানে উঠে এসেছে। সেই শক্তিতে বিজেপি দাবি করছে পশ্চিমবঙ্গে দলগতভাবে ২০-২২টি আসন দখল করবে।
বিজেপির উল্কার গতিতে এগিয়ে আসা আটকাতে রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সফল জোট হলনা। কেন? সে বিষয়ে বিভিন্ন মত উঠে আসছে। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ চলছে। চাপানউতোর চলছে। পরস্পরকে দোষারোপের পালা শুরু হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে অমলেশ ত্রিপাঠী তার ‘স্বাধীনতা আন্দোলন এবং কংগ্রেসের ইতিহাস’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘’আজকের কংগ্রেসের কাছে অতীতের সাফল্য বা উজ্জ্বলতার কোনও গুরুত্ব নেই। কারণ দীর্ঘায়ত জীবনের সত্য কি? এটাই জাতি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সহায়ক হয় মুক্ত বিশ্বের মুখোমুখি হতে।‘’ কংগ্রেস সভাপতি অতীতে দেশে বিদেশের বিভিন্ন সেমিনারে আত্মসমালোচনা করেছেন। আধুনিক ভারতের আলোয় কংগ্রেসকে গড়তে চাইছেন তিনি। তবু পশ্চিমবঙ্গে বামেদের সঙ্গে জোট হল না। কেন জোট হল না? এই বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে, কংগ্রেস, সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন শীর্ষনেতার সঙ্গে কথা বলি। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য এবং লোকসভার প্রার্থী মহঃ সেলিম দিন দশেক আগে আমাকে বলেন, টাকার খেলা হয়েছে। বিভিন্ন এজেন্সি টাকা ছড়াতে পারে। সম্প্রতি মহঃ সেলিমের কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবসুর ক্ষেত্রে। তৃণমূল কংগ্রেসের এক শীর্ষনেতার বক্তব্য, শত্রু যদি দুর্বল হয়, তাতে আমাদের লাভ। তিনি আমাকে একান্তভাবে বলেন, কংগ্রেস এবং সিপিএমের প্রার্থী কি আমরা দিয়ে দেব? ওরা ওদের প্রার্থী দিক আমরা আমাদের কাজ করব। রাজ্যে লোকসভা ভোটে ‘জোট সমীকরণ’-কে ঘিরে উন্নত এক ঘরানার সন্ধান আমরা পাচ্ছি সম্ভবত। অদৃশ্য সেই সমীকরণের কথা কংগ্রেস নেতৃত্বের মুখেও। কংগ্রেসের জোটপন্থী নেতাদের বক্তব্য, কংগ্রেসের লড়াই কিছুটা দুর্বল হল হয়ত। জান থাকলে, মান থাকলে তবেই দল থাকবে। মানুষের দাবি মেনে আগে জানে বাঁচতে হবে।                                                

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?