আত্ম-অন্বেষায় ‘নান্দীমুখ’ ছবির জীবনের রঙিন উৎসব


দীপেন্দু চৌধুরী
সমাজ এবং সময় আমাদের হাত ধরাধরি করে চলতে বলে। যেন একে অপরের বন্ধু। আবার আমরা কখনও কখনও সৃষ্টিশীল সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে পরস্পরের সঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হই। একুশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ নিজেকে চিনতে, নিজের কথা চেনাতে নতুন কিছু কি ভাবছে?   
সদ্য কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব যেমন ২৪ বছরে পড়ল আবার বাংলা ছবির শতবর্ষ উদযাপন। ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের দিনে উৎসব কমিটির সভাপতি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন ১৯১৮ সালে তৈরি নির্বাক কাহিনীচিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’-এর কথা। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর। চলচ্চিত্রের ইতিহাসবিদরা বলেন, ১৯১৮ সালের অনেক আগে বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক হীরালাল সেন নাটকের ছবি তোলেন। এবং বানান বিঞ্জাপনের জন্য ছবি। ১৯১৭ সাল থেকে বাংলা সিনেমার শুরু হলেও অথবা মতান্তরে ১৯১৮ সালে তৈরি বাংলা ছবি বিল্বমঙ্গল নির্মাণ হওয়ার ঢের আগে হীরালাল সেন ছবি করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত হীরালাল সেন-এর যুগ। শিশির মঞ্চ সংলগ্ন অভিজাত প্রদর্শনী সভাঘর ‘গগনেন্দ্র প্রদর্শন সভাঘরে’-এ আটদিন ধরে আয়োজন করা হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্র এবং সংস্কৃতি বিষয়ক স্থায়ী চিত্রপ্রদর্শনীর। এই পরিকল্পনার রূপকার প্রসেঞ্জিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন। ওই প্রদর্শনী কক্ষে আলাপ হল পশ্চিমবঙ্গ তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের প্রাক্তন আধিকারিক এবং নাট্যকর্মী সঞ্জয় ঘোষ দস্তিদারের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘’১৯৫২ সালে কলকাতায় প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে ‘ডাইরেক্টর অফ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৭৮ সাল, ১৯৮২ অর্থাৎ চার বছর অন্তর কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন বড় শহরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হত। ১৯৯৫ সাল থেকে আমাদের রাজ্যে তৎকালীন রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত বামফ্রন্ট আমলে সরকারের কিছুটা রক্ষণশীলতা ছিল। তৃণমূল সরকার এসে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে আরও জনপ্রিয় করেছে। এবছর ২৪তম ‘ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে। সামনের বছর ২৫ বছর পূর্ণ হবে। এই উৎসবের রজতজয়ন্তি বর্ষ। এবছর মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা ছিল বাংলা সিনেমার গান। চিত্র প্রদর্শনী। যে প্রদর্শনী আপনি দেখছেন। নজরুলতীর্থে স্থায়ী চিত্র প্রদর্শনী থাকবে। এক বছর ধরে বাংলা ছবির শতবর্ষ উদযাপন হচ্ছে।‘’
১০ নভেম্বর ২৪ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চল্লচ্চিত্র উৎসবের সূচনা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘’The status of the festival, was on a downslide before we came to power. We showed things could be done if you wanted to.’’
প্রদর্শনীর তিনটে ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রদর্শনী কক্ষে ছিল ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত। ১৯৮০ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রদর্শনী কক্ষের বাইরের দেওয়াল। অভিনব পরিকল্পনা। শিল্পরসিকরা শতবর্ষের বাংলা চলচ্চিত্রের সালতামামি ভেতরে- বাইরে মিলিয়ে একটি প্রদর্শনী থেকেই পেয়েছেন। এই প্রদর্শনী থেকেই আমরা জানতে পারি ‘নিউটেন্ট ময়দান এলথিনটোন স্টোন বায়োস্কোপ’ সংস্থা এবং জে এফ ম্যাডার্ন (১৮৫৬-১৯২৩) বাংলা সিনেমার প্রথম প্রজোজক, পরিবেশক ও প্রদর্শক। যদিও এর অনেক আগে ১৯১৭ সালের ২৪ মার্চ পরিচালক হীরালাল সেন ( ১৮৬৬-১৯১৭) প্রদর্শন করেন বাংলা ছবি ‘সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র’। তিনি ছিলেন বাংলা সিনেমার পথিকৃৎ হীরালাল সেন নাটকের ছবি তুলেছেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিষয়ক ছবি করেছেন। এই ছবিকে চলচ্চিত্রবিদরা ভারতের প্রথম রাজনৈতিক ছবি বলছেন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসবেত্তাদের দাবি ‘নান্দীমুখ’ যুগের পদাতিক ছিলেন তিনি। তাঁকে স্মরণে রেখে উৎসব কমিটি তাঁর নামে পুরস্কার দেওয়া শুরু করেছে। এটা অবশ্যই আমাদের অহংকার বলতে হবে।         
সঞ্জয়বাবুর কথার সূত্র ধরে আমরা মনে করতে পারি বাংলা ছবির প্রবাদ প্রতিম নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। তিনি স্মৃতি উসকে দিয়ে বলছিলেন, ‘’ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সারা পৃথিবীর ভাল ভাল ছবি আসে, সেই সব  ছবি দেখার জন্য আমরা উৎসুক হয়ে থাকি।‘’ ১৯৫২ সালে সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, বাসু চ্যাটার্জী সহ আরও অনেকের উদ্যোগে গঠিত ‘সিনে ক্লাব’- এর ব্যানারে স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পরিচালকদের ছবি কলকাতা দেখেছে। এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক টুকরো টুকরো এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, হলিউডকে দেখেছে। বাংলার সাংস্কৃতিক উঠনে আমরা কালজয়ী আন্তর্জাতিক ছবি দেখেছি। আমার মনে পড়ছে ১৯৭৮ সালের কথা। আমি তখন কলেজের ছাত্র। সুদূর বীরভূম থেকে আমরা এসেছিলাম ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দেখতে। সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছিলাম। খুব সম্ভবত সেই বছর প্রথম গোদারের ছবি কলকাতায় আসে। তখন থেকেই কিছু দর্শকের সঙ্গে আমাদের দেখা হতে থাকে যারা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘নীল চোখে নীল ছবি’ দেখতে পাব এই আশায় ছবি দেখতে আসতেন। কিন্তু শিল্পসুষমায় ভেজানো সেলুলয়েডের প্রয়োজনে নরনারীর অর্ধ উলঙ্গ অথবা সম্পূর্ণ উলঙ্গ দৃশ্য দেখে তাঁদের আশ মিটতনা। আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে এমন সব পরিচালকের দেড় ঘণ্টা, দু’ঘণ্টার ছবি উল্লেখিত দর্শককূল একঘণ্টা দেখে বিরক্ত হয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে যেত। ধ্রুপদী জীবন শিল্পের কাছে তাঁরা ‘মূর্খের মুখ’ হিসেবে সেদিনও পরিচিত ছিলেন আজও তাঁরা একই সংজ্ঞায় খ্যাত।   
এই কারণে আমরা আর্নস্ট ইঙ্গেমার বার্গম্যানের কথা উল্লেখ করতে পারি। বিশ্ববরেণ্য পরিচালকরা কেন সিনেমা করেন? বার্গম্যান বলছেন, ‘’চলচ্চিত্র নির্মাণ করা এক স্বাভাবিক প্রয়োজন, যেমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা নিবৃত্তি। আত্মপ্রকাশ অর্থে কারও কাছে গ্রন্থ রচনা, পর্বতারোহণ, শিশুদের প্রহার বা সাম্বা নৃত্য করা আমি নিজেকে প্রকাশ করি ছবি তৈরির মাধ্যমে।‘’
বার্গম্যনের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের কোথাও একটা মিল আছে। সত্যজিৎ অপু ট্রিলজি করেছিলেন। বার্গম্যানও ট্রিলজি করেন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে নির্মিত তিনটে ছবি যথাক্রমে ‘অস্পষ্ট কাঁচের আলোয়’, ‘শীতের আলো’ এবং ‘নৈঃশব্দ’। চলচ্চিত্র সমালোচকরা বলছেন, তিনি আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মরতির অসুখ তাঁর দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন এই তিনটে ছবির মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব স্বল্প দৈর্ঘের ছবি থাকবে না? এ বছরের উৎসবে স্বল্প দৈর্ঘ এবং তথ্যচিত্রের ছবির সংখ্যা ছিল ৩২২টি। স্বল্প দৈর্ঘের ছবি ‘হোমল্যান্ড’-এর পরিচালক অনিন্দ্য চ্যাটার্জী ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে জানালেন তিনি তাঁর ছবি ‘অভিবাসন’ বিষয়কে কেন্দ্র করে তৈরি করেছেন। শুটিং হয়েছে ফ্রান্স, জার্মানী সীমান্তের ‘কম্যাকসি’ নামে একটি গ্রামে। তিনি বলেন, ‘’প্রত্যেকটা সীমান্তের একটা নিজস্ব ম্যাপ আছে। মাদারল্যান্ড, ফাদারল্যান্ড-এর শব্দ সম্পর্কে অভিধান এবং ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। কিন্তু ‘হোমল্যান্ড’ শব্দটা নিয়ে আমরা তেমন কিছু পাই না।‘’
সাংবাদিক সম্মেলনে ১৬ নভেম্বর সুযোগ হয়েছিল ‘পিকু’ ছবির পরিচালক সুজিত সরকারকে প্রশ্ন করার। এবারের উৎসবে তাঁর ছবি ‘অক্টোবর’। সাংবাদিক সম্মেলনে সেদিন তিনি বলেন, ‘’আমার ছবিতে বাংলার একটা টাচ থাকে। পিকু ছবিতে ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র ছিল। ‘অক্টোবর’ ছবিতে শিউলি আছে। আমি বাংলা ছবি করতে চাই।‘’
সুজিত সরকারকে প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলায় দিকপাল লেখকদের উপন্যাস, ছোটগল্প রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বনফুল, বিমল কর, তারাশঙ্কর, মানিক, রমাপদ চৌধুরী, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ মজুমদারআপনি কি ভাবতে পারেন না? এইসব লেখকদের লেখা থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করার কথা? উত্তরে সুজিত সরকার বলেন, ‘’আপনার কথার সঙ্গে আমি একমত। বাংলা সাহিত্যে খুব ভালো চিত্রনাট্যের গল্প আছে। আমরা প্রস্তুত হচ্ছি। পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে তবে কোন লেখকের গল্প সেটা এখনই বলতে পারব না।‘’
‘বিসর্জন’ নামে একটা শব্দ আছে বাংলায়। দুর্গার বিসর্জনের পরেই আমাদের কৃষ্টি আমাদের বাড়ির এয়োতি মেয়েরা সিঁদুর খেলে। আমরা আপামর বাঙালি ‘বিজয়ার উৎসব’ পালন করি। ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে পরস্পরে আলিঙ্গন করি। কোলাকুলি করি। আগামীর আহ্বান করি। উৎসবের শেষদিন নজরুল মঞ্চে ১০০ বছরের সাদাকালো থেকে রঙিন জীবনের নৃত্যনাট্যের শৈলি দেখিয়েছেন ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের স্কুলের ২০০ ছাত্রছাত্রী। রজতজয়ন্তী বর্ষে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আরও বড় আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখলেন তথ্য- সংস্কৃতি সচিব বিবেক কুমার। উৎসব অধিকর্তা মহুয়া ব্যানার্জী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেন, ‘’মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় এই উৎসব আমরা সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছি। এত মানুষ। প্রাণোচ্ছল যুব সম্প্রদায়ের উন্মাদনা। এটাই সবচেয়ে পাওয়া এই উৎসবে। বিদেশিরাও সকলেই খুব খুশি। একটা বছর অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে কাটবে। রজতজয়ন্তি বর্ষে উৎসবের ‘টাচ’ আরও ধ্রুপদী হোক।‘’  
(এই লেখাটি গত বছর নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে লেখা। লেখাটি আমার এই ব্লগে প্রকাশ করলাম। কারণ আগে যে ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেছিলাম, সেই সাইটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লেখাটি একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে লেখা। রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অধিকর্তারা সে সময় আমাকে সব রকমের সাহায্য করেছিলেন।)            


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?