প্রতিবাদ-প্রতিবাদীর স্বর ‘নান্দনিক’ ঘরানা দাবি করে



দীপেন্দু চৌধুরী
ডোর বেল বাজতেই আমি দরজা খুলে দেখতে বেরলাম। কারণ সকাল এগারটায় সাধারণত আমাদের বাড়ি কেউ আসে না। হকার, হকারনি থুরি মহিলা হকার কেউ আস্তে আগ্রহী নয়। কারণ স্থানীয় মানুষের মাধ্যমে তাঁরা জেনে গেছে এঁদের সীমাবদ্ধ আয়। এঁরা গোষ্ঠগোপালের আত্মীয়। গোষ্ঠগোপালের মতই জীবন যাপন। দরজা খুলে দেখি কমল এসেছে। আপনাদের মনে আছে কমল আমার ছোটবেলার  বন্ধু। বীরভূমের বন্ধু। খুব সম্ভবত বছর দুয়েক পরে এল। কমলের পোশাক দেখে না হেসে থাকতে পারলাম না। আমি গ্রীলের গেট খুলতেই কমল সেলাই করা প্ল্যাস্টিক চপ্পল খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। জামা বলতে একটা হাত কাটা গোল গলার জামা। হাঁটুর নীচে পর্যন্ত ঝুলছে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে চন্দনের তিলক। নাকে লাল রঙ লাগানো। কাঁধে মার্কিন কাপড়ের তৈরি বোষ্টমী ব্যাগ। ঘরে ঢুকেই হাত কাটা গোল গলার জামাটা তুলে বলল, ‘এই দ্যাখ দ্যাখ, দ্যাখ ক্যানে, আমি ল্যাংটা হুং আসিয়েনি। শর্টস পোড়াছি। তু ভেবাছিস জামার তলায় কিছু লায়? তুদের নাগরিক ফুটপাথ থেকি অনেক খুঁজি তবে এই প্যান্ট পেয়াছি। বাবু হকার গুলান বুলছে বারামুডা আছে। আমি এই প্যান্টটো পেলাম। লিং লিলাম।’
আমি মুচকে হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমি কিছু জানতে চেয়েছি? তোর এতো তৎপর হওয়ার কি আছে?’
‘না ভাই তু এখন আর গাঁ গঞ্জের ছেলা লস। তু এখন শহর নগরের ‘বাবু’ শ্রেণির লোক বটিস। চামড়ায় পালিশ লেগাছে সেই ৮৬ সালে। যখন তু ল্যাং খেং বাবুদের শহরে এসাছিলি। ৩৩ বছর হুং গেলরে। এখন কথা মেপে বুলিস। লে এক কাপ চা খুয়া। আর কিছু খাব না। আমি সন্ন্যাস লিয়াছি কিনা। একাহারি এখন। লে লে চা বানা খানিক। আমি বিড়ি ধরাই।’
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না। বলছিস সন্ন্যাস নিয়েছিস। একাহারি। মানে দিনে একবার খাস। তা হলে চা খাবি যে বড়?’
‘ওই দ্যাখ কাকে কি বুলছি। উপোস করলি বামুনের ঘরের বিধবারাও চা, সরবত খেয়ে না? বুল ঠিক বুলছি কিনা? আচ্ছা আমি চা করে লিছি। তোর আন্নাঘর আমি চিনিয়ে। বৌ লায়। আমি করে লিছি।’ আমার আপত্তি শোনার আগেই কমল রান্না ঘরে গেল। আমি সঙ্গে গেলামওকে সব দেখিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে এসে দেখি জানলার গ্রীলের শিকে হুতোম বসে আছে। আমাকে দেখে হাসল। দাঁত আছে কিনা বুঝতে পারলাম না। হুতোমদের কি দাঁত হয়? দাঁত ভ্যাংচায়? হনুমানদের মতো?
হুতোম হঠাত বলল, ‘নে লিখতে বোস। ওই যে যারা সিনেমা নিয়ে আন্দোলন করছে। সেই বিষয় নিয়ে কিছু লিখবি না?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ সে তুমি না বললেও আমি লিখতাম।’
‘লিখবি আমি জানি। কিন্তু তুই বাছবিচার না করে কাকে গালি দিয়ে দিবি। শিল্প মানে আধার। আধার কার্ডের মতো। তথ্য ধরা থাকে যাতে। সৃষ্টি করবি বলে ব্যক্তিকে গালি দিবি?  তাই ভাবলাম একটু মাতব্বরি করে আসি। শোন তোকে একটা কথা বলি। তোদের এই বাংলায় যদি হাজার টাকার উপর কালো কয়লা দিয়ে ঘসিস, দেখবি সোনা হয়ে যাবে। আবার একভরি সোনার আংটিতে যদি কালো কয়লা দিয়ে ঘসিস, দেখবি হাজার হাজার টাকা বেরিয়ে আসছে।’
‘কি সব আজে বাজে কথা বলছ তুমি?’
আমার প্রশ্নের উত্তরে হুতোম বলল, ‘না না সত্যি বলছি। একদম জাদু। কয়লা না হলেও চলবে। কাঠ কয়লা দিয়ে ঘস্তে হবে। পেনসিলের লিড দিয়ে ঘসলে কিন্তু হবে না। কালো কিছু দিয়ে লোহাতে ঘসে দেখ পরশ পাথরের কাজ করবে। এসব মায়ার কথা বলছি না। তোদের বাংলায় হরবোলাদের সময় চলে গেছে, পুতুল নাচের সময় চলে গেছে। এখন ‘মিম’। বাজারে ঝরা পাতার মতো টাকা উড়ছে। ধরতে জানতে হবে। গোষ্ঠী চিনতে হবে। রতনে রতন চেনে যেমন। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। সিনেমায় টাকা। সাহিত্যে টাকা, গানে টাকা। সব ‘মিম’ করে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখ। চক চক করবে। পালিশ দেওয়া নেতাবাবুদের মতো। আমি এখন চলি তোর বন্ধু আসছে।’
কমল চা খেতে খেতেই বিড়ি ধরাল। চা, বিড়ি খেয়ে বোষ্টমী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে বলল, ‘আজ যেছি। সামনের হপ্তায় আবার আসব।’ কমল বেরিয়ে গ্যালো। আমি ছাদে দাঁড়িয়ে ওকে দেখলাম। রাস্তার দুধারের বাড়ির লোকেরা ওকে দেখে হাসছে। পরস্পর পরস্পরকে আঙ্গুল দিয়ে কমলকে দেখাচ্ছে। যেন অর্ধ উলঙ্গ, পাগল সন্ন্যাসী হেঁটে চলেছে। কমল নির্বিকার। নিজের ছন্দে পাগল সন্ন্যাসীর মতো আমাদের পাড়া পড়শিদের লাল, সাদা, কালো নাকের ডগা দিয়ে হেঁটে চলেছে কমল
আমি ফিরে এসে লিখতে বসলাম। কি লিখব? কেন লিখব? ভাবছি। হুতোমের কথা মনে পড়ল। ব্যক্তি আক্রমণ করতে নিষেধ করেছে। আমাদের রাজ্যে একটি ছবির প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে চাপানউতোর চলছে। ছবি প্রদর্শন নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। অলিখিত নির্দেশে। কেউ কেউ বলছে ছবিতে এমন কিছু বিষয় আছে একটি রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করা হয়েছে। শিল্পের দাবি সে ক্ষেত্রে মানা হয়নি। আমি ছবিটি দেখিনি। তাই জানি না। কি আছে আর কি নেই। তবে মনে পড়ছে কবি, ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসুর কথা। তার লেখা ‘রাত ভোর বৃষ্টি’ উপন্যাস নিষিদ্ধ ছিল ছ’বছর। মামলা জিতে তিনি আবার বই বাজারে এনেছিলেন। সমরেশ বসুর বিবর, প্রজাপতি নিষিদ্ধ হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্কদের উপন্যাস এই অভিযোগে। বারবধূ নাটক নিষিদ্ধ হয়েছিল। বামফ্রন্ট আমলে তসলিমা নাসরিন সহ আরও অনেকের সৃষ্টি নিষিদ্ধ হয়েছে। প্রশাসনিক এবং আমলাতান্ত্রিক কৌশলে নিষিদ্ধ হয়েছিল একাধিক সিনেমা, সাহিত্য, এবং নাটক। শিল্প সম্মতভাবে সৃষ্ট সাহিত্য, নাটক, সিনেমা শাসকের বিরুদ্ধে গেলেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আপামর বিশ্বে এটা বস্তব যে ভিন্ন কন্ঠের, ভিন্ন  মতের, দর্শনের অধিকারকে মেনে নেবার বা স্বীকার করার শক্তি দুর্বল শাসকের থাকে না। কারণ হিসেবে বলা যায়, শিল্প সাহিত্য মান উত্তীর্ণ নয়। এমন ধারার সৃষ্টিকে কি বলা হয়? শিল্প সাহিত্য মানে নিশ্চয় রাজনৈতিক বিঞ্জাপন নয়। সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে সাধারণ দর্শকদের মতও সেটাই বলে।  একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনও গাফিলতি থাকবে না, বা দুর্নীতি থাকবে না এমনটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান আধিকারিক নিজেও ভাবেন না। শিল্প দাবি করে দুটোই, যেমন  শিল্পের জন্য শিল্প এবং জীবনের জন্য শিল্প।
আসলে হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকারকে অমান্য করার ব্যক্তিক ক্ষমতার দাপট। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আমরা পেয়েছি। মুম্বাইয়ে পাকিস্তানী গায়ক গুলাম আলির অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পাকিস্তানী গায়ককে কলকাতায় ডেকে এনেছিলেন। অনুষ্ঠান করার জন্য। পদ্মাবত ছবি প্রদর্শন বন্ধ করার সময়ও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে পদ্মাবত প্রদর্শনের সব ব্যবস্থা করা হবে। আমরা ভরসা করেছিলাম মুখ্যমন্ত্রীর উপর। তিনি শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, কবির স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাস করেন এই আশায় তার উপর বিশ্বাস এবং আস্থা আমাদের আছে। কারণ তিনি নিজেও কবি এবং লেখক। আমার নিজের অভিঞ্জতা, গত বছর দুয়েক আমি এমন কিছু সর্টফিল্ম, তথ্যচিত্র, কাহিনীচিত্র দেখেছি সেগুলি অত্যন্ত উন্নত মানের। বিষয় জেন্ডার বেসড, মানব পাচার, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জীবন যুদ্ধের গল্প, দেশের গৃহ পরিচারিকাদের জীবন্ত সমস্যা, উত্তর বিশ্বায়ন সমাজ ব্যাবস্থা, অভিবাসন ইত্যাদি। এইসব ছবি তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা তৈরি করেছেন। কোনও রকম সরকারি অনুদান বা সাহায্য ছাড়া তাঁরা এইসব ছবি করেছেন। ওই ছবির পরিচালকদের অনেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন এমন দু’একটি নকশালপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য। মার্কসবাদ-লেনিনবাদে তাঁরা বিশ্বাস করেন। তাঁরা সহযোগিতা পাচ্ছেন বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসের সাংস্কৃতিক শাখার। কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে এইসব বিষয়কে বিষয় করে ছবির প্রদর্শন এবং আলোচনাসভা হচ্ছে। এই বাংলায় এখনও সাহিত্য, সিনেমা, নাটক বেসরকারি একটি বিশেষ গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করছে। অভিযোগ অনেকের। শহর বাজারে কান পাতলে এমনটাই শোনা যায়।                                     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?