বিচ্ছিন্নতা নয় মানবিক ‘অনুভূতি’ হোক নতুন ভারতের আহ্বান



দীপেন্দু চৌধুরী 
পুলওয়ামার জঙ্গি হানার পর এপর্যন্ত ৪৯ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। গোটা দেশে শোকের পরিবেশ। দেশের শহর গ্রাম গঞ্জ পাড়া, আধুনিক মল, ট্রেন বাসে, পুরনো হাট বাজারের স্বাভাবিক ছন্দ থাকলেও আলোচনার খাতায় হিজিবিজি শব্দ। বিষয় কাশ্মীর এবং জম্মু। আজকের (১৭ ফেব্রুয়ারি) প্রভাতি সংবাদপত্রের ভেতরের দিকের পাতার খবরের শিরোনাম ‘জম্মুতে নিশানায় কাশ্মীরিরা’ এবং সংবাদের বিস্তারে প্রকাশ পুলওয়ামার জঙ্গি হামলার জেরে কার্যত বিরোধ দেখা দিয়েছে জম্মু এবং কাশ্মীরের মধ্যে। জম্মুতে জনতার হামলায় আহত হয়েছেন ৩৭ জন। পুলওয়ামারে জঙ্গি হানা অবশ্যই এক কথায় ঘৃণ্যতম কাজ। পাশাপাশি এটাও একশো শতাংশ সত্যি ভারতের জম্মুর সব ধর্ম বর্ণের মানুষ আমাদের আত্মীয়। আমাদের স্বজন। মানবতার দর্শন বলে ঘৃণা নয় ‘আলিঙ্গন’ হোক আজকের ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম দুই দেশের আম নাগরিকদের প্রাত্যহিক দাবি। ঝড়া পাতার শোক মুছে যাক মানবতার ডাকে। বয়ে আনুক নতুন বসন্তের সূর্য ওঠার ভোর। প্রথমপাতায় সংসদীয় নেতাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রের সংসদীয় মন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমারের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে (১৬ ফেব্রুয়ারি) অত্যন্ত পরিণত রাজনীতির আলোচনা হয়েছে বলা যায়।
ভারত আধুনিক গণতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিজেদের অবস্থান অনেকখানি উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছে এদিনের বৈঠকে। ঐক্যবদ্ধ ভারত (ইউনাইটেড ইন্ডিয়া)-এর মঞ্চ বর্তমান সময়ে পোক্ত। সংবাদে প্রকাশ ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গোটা দেশ আজ একসুরে কথা বলছে, দেশের পাশে সমস্ত দল রয়েছে’ বৈঠকে সরকারের তৈরি করা প্রস্তাবিত খসড়ার এই বাক্যগুলিতে সবদলের সাংসাদেরা অনুমোদন দেয়। সুত্রের খবর খসড়ার শেষাংশে ছিল ‘আজ আমরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষীদের পাশে দাঁড়িয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে জানাতে চাইছি যে, এই চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত এবং কঠিন প্রত্যুত্তর দেওয়া হবে।’ সংবাদে প্রকাশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত খসড়ার কোনও কপি বৈঠকে উপস্থিত অভিঞ্জ এবং বরিষ্ঠ সাংসদদের মধ্যে বিলি করা হয়নি। খসড়াটি পড়েন বৈঠকে উপস্থিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব রাজীব গৌড়া। এই বিষয়টাতে প্রথম আপত্তি জানায় তৃণমূল কংগ্রেসের দু’জন সাংসদ। তাঁদের বক্তব্য এই ভাবে সাদা চেকে সই করে দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের কাছে খসড়ার কোনও কপি নেই। পরে কংগ্রেস সহ অন্যান্য দলের সাংসদরাও সই করতে আপত্তি জানায়। দেশ চাইছে না প্রতিবেশী কোনও দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যাক। এই হচ্ছে শনিবারের সর্বদলীয় বৈঠকের বিরোধী দল গুলির অভিমত।    
ভারতীয় আধুনিক গণতন্ত্রের অনুশীলনে আমরা আবার ‘মানবিক কণ্ঠস্বর’ শুনতে পেলাম।  উল্লেখ করতে হয় কাশ্মীরের প্রবীণ নেতা ফারুক আবদুল্লার বক্তব্য। তিনি বৈঠকে বলেন, ওই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশের সঙ্গে কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ যেন ব্যাপক আকার না নেয়। সেই বিষয়টা সবার আগে দেখতে হবে। সরকার যদি কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নেয়, তিনি এবং তাঁর দল সঙ্গে থাকবেন। কংগ্রেসের পোড় খাওয়া কাশ্মীরের নেতা গুলাম নবী আজাদ জানান, ৭০ বছরের ইতিহাসে শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে একক আঘাতে এটাই সব চেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতি। তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব দিয়েছেন, প্রথমসারির সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা বা সভাপতিকে নিয়ে দ্রুত আরও একটি বৈঠক ডাকা হোক। প্রধানমন্ত্রী নিজে সেই বৈঠকে উপস্থিত থাকুন।
লোকসভা ভোটের আগে মোদী সরকারের কাছে কি ‘স্বস্তি’র অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে কাশ্মীরে আত্মঘাতী জঙ্গি হানা? প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশেষঞ্জরা। কারণ গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিক কৃষি সঙ্কট, কৃষকের আত্মহত্যা, চাকরির অভাব, দেশে শিল্পের বৃদ্ধির হার নিম্নগামী ইত্যাদি কারণে কেন্দ্র উদ্বিন্ন ছিল। তথা বিজেপি দলগতভাবেও চিন্তায় ছিল। এইসব বিষয় মাথা রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী ১৫ ফেব্রুয়ারি বলেন, ‘যারা সমালোচনা করছেন, তাঁদের ভাবনা আমি বুঝি। সেই অধিকারও রয়েছে। কিন্তু একজোট হয়ে এই হামলার মোকাবিলা করতে হবে।’ কংগ্রেস প্রথম থেকেই নতুন করে আর ভারত ভাগ চায় না। সেই কথা মাথায়ে রেখে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি পুলওয়ামারে ভয়াবহ জঙ্গী হানার পর বলেছিলেন, ‘এই দেশকে কোনও শক্তি ভাঙতে পারবে না, বিভাজিত করতে পারবে না। গোটা বিরোধী শিবির আমাদের জওয়ান এবং সরকারের সঙ্গে রয়েছে।’
শনিবারের বৈঠকে সেই ‘স্পিরিট’ আমরা লক্ষ করলাম। বিজেপি দলের অন্দরের খবর, ‘তোমরা একটা মুম্বাই করতে পারো, কিন্তু তোমাদের বালুচিস্তান হারাতে হবে।’ এই দর্শনের বিরোধী শাসক দলের অনেক শীর্ষনেতা কারণ বালুচিস্তান সমস্যা আমাদের প্রতিবেশী দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। কাশ্মীর সমস্যা আমাদের দেশের সমস্যা। যে কথা গত বছর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। গত বছর একটি বেসরকারি চ্যানেলে সাংবাদিক করণ থাপারের নেওয়া সাক্ষাৎকারে কথাগুলি বলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন।
‘’Nobel laureate Amartya Sen told India Today that the recent unrest in Kashmir has been grossly mishandled by the Indian government to the extent that the region reflects as the biggest blot on Indian democracy in the West.
"It is the biggest blot on Indian democracy. There's no question about that. There are a number of claimants to that position of being a blot. It is a case that figures a lot in foreign discussions. On my first night when I came here, a long CNN coverage on the brutality of policing and law and order was aired," said Sen, one of the world's greatest scholars, Nobel Prize winning economist, former master at Trinity College, Cambridge, and a Harvard University professor.
Kashmir mishandled for decades
"I don't deny that Kashmiris are meant to be Indians. The Kashmiris' attitude to rest of India has varied a lot. Basically, we have mishandled it for a number of decades. Right now, we are mishandling it very badly indeed," said Sen in an exclusive interview with Karan Thapar on his show To The Point.

"It is not a law and order problem. It is the people of Kashmir we are looking at. It is quite important to do the law and order right. The kind of horrific and violent treatment of protest and also banning newspapers will isolate Kashmiris. All these are penalizing Kashmiris in a way is giving them absolutely no reason to feel close to India," he said.’’

জম্মুর সব ধর্ম বর্ণের মানুষ আমাদের আত্মীয়। সংবাদে প্রকাশ জম্মু এবং দেশের অন্যান্য অংশে কাশ্মীরিদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার দাবিতে শ্রীনগরে মিছিল করেন একদল বিক্ষোভকারী। জম্মুতে গণ্ডগোলের প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থনেপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, ‘জম্মুতে দুষ্কৃতিরা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে। যেটা দেখে আমি উদ্বিন্ন।’ ন্যাশন্যাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লার বক্তব্য, ‘কাশ্মীরি বা মুসলিমরা সিআরপিএফ জওয়ানদের উপর হামলা করেননি। করেছে জঙ্গিরা। ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে নিরীহ মানুষের উপরে হামলা চালিয়ে জওয়ানদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো যাবে না।’   

সংবাদে প্রকাশ, জম্মু, দিল্লি, পুণে, হায়দ্রাবাদ, জয়পুর, পটনা, দেরাদুন, কলকাতা, বেঙ্গালুরু চেন্নাই সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দার তার সংগঠনের মাধ্যমে আক্রান্ত কাশ্মীরিদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিরাপদ স্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। জম্মু সহ বিভিন্ন শহরে শিখরা গুরুদ্বার খুলে দিয়েছেন। রাহুল গাঁধির নির্দেশে কংগ্রেস কর্মীরা সারা দেশে কাশ্মীরিদের নিরাপত্তা দিতে পাশে রয়েছেন। বামপন্থীরাও সামনে থেকে না হলেও আড়াল থেকে কাশ্মীরিদের পাশে রয়েছেন নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়েই। আজ আমাদের আবার পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে কার্গিল সংঘর্ষে নিহত জওয়ানের মেয়ে গুরমেহর কৌরের বলা কথা। যুদ্ধ হচ্ছে মানবতার ‘প্রকৃত শত্রু’। পশ্চিম সীমান্তে আমরা সবাই শান্তি চাই। ভারত অহিংসার পূজারী           

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?