বাংলা এগিয়ে মানে ভারত এগিয়ে



দীপেন্দু চৌধুরী
গত বছর ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’- এ এসে মুকেশ অম্বানি বলেছিলেন, ‘’দিদি, আপনার নেতৃত্বে ওয়েস্ট বেঙ্গল ‘বেস্ট বেঙ্গল’ হয়েছে।‘’  ভারতের বৃহত্তম শিল্প গোষ্ঠীর কর্ণধারের বলা গত বছরের কথাগুলির প্রমাণ এ বছর পেলাম আমরা। রাজ্যের ‘শিল্পবান্ধব’ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানসিকভাবে এতটাই দৃঢ় যে, শুধু নিজের রাজ্যের জন্য নয়। সারা দেশের জন্য বিনিয়োগ আহ্বান করলেন এই বছরের বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন থেকে রাজ্য ছাড়িয়ে সারা দেশের জন্য ভাবছেন সুপ্রশাসক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা ভারতের গণ আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী  
চলতি বছরের মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা তাৎক্ষণিক কোনও বিষয় নয়। সুচিন্তিত মতামত বলতে হবে। রাজ্যের বিরোধী দলগুলি রাজ্যের বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান নিয়ে যতই সমালোচনা করুক ‘বাণিজ্য-বন্ধু’ রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ স্বীকৃতি পেয়েছে এক বছর আগেই। প্রতি বছরই কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীন ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি অ্যান্ড প্রোমোশন (ডিআইপিপি) রাজ্য গুলির র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। ‘বিজনেস রিফর্মস অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে ওই র‍্যাঙ্কিংয়ে ২০১৭ সালের তালিকায় আমাদের রাজ্যকে ‘বাণিজ্য-বন্ধু’ হিসাবে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঝাড়খন্ড, এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাট তৃতীয় স্থানে নেমে যায়। ২০১৪ সালে যে তালিকা প্রকাশ হয়েছিল সেটাই ছিল এই বিষয়ে প্রথম তালিকা।
ওই তালিকায় ৩১টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছিল ২২ নম্বরে। এই তালিকা প্রকাশের পরেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’-এর শর্ত পূরণের জন্য বরিষ্ঠ আমলাদের নিয়ে বিশেষ টিম তৈরি করে দিয়েছিলেন। এর পরেই রাজ্যের মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে সেই কমিটি প্রতি মাসে বৈঠক করে রাজ্যের লগ্নি সহায়ক পরিবেশ তৈরির কাজে হাত দেয়। শিল্প দপ্তর সূত্রে খবর, বিশ্ব ব্যাঙ্কের উপদেষ্টা এবং ডিআইপিপি প্রতি বছরই সংস্কারের শর্তাবলি বদলে বদলে দেয়। এই কারণে রাজ্যকেও আইন-কানুনের পরিবর্তন করতে হয়। না হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। ২০১৫ সালে ৯৮টি সংস্কার শর্তের ভিত্তিতে যে র‍্যাঙ্কিং হয়েছিল তাতে রাজ্য ছিল ১১ নম্বরে। পরের বছর ২০১৬ সালে ৩৪০টি শর্তের উপর নতুন করে মূল্যায়ন করা শুরু হয়। সেই জন্য আবার রাজ্যের র‍্যাঙ্কিং ১৫ নম্বরে নেমে যায়।
২০১৭ সালে ৪০৫টি শর্তপূরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হয় বিজনেস রিফর্মস অ্যাকশন প্ল্যান। ১২টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য এই শর্তগুলি রাখা হয়েছিল। সেসবের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, শ্রমিক আইন সংস্কার, এক জানলা পদ্ধতির ই-প্রয়োগ, শিল্পের জন্য পরিকাঠামো যুক্ত জমির পরিবেশ ছাড়পত্র, পুর-পঞ্চায়েত-বিভাগীয় ছাড়পত্র, নির্মাণ ছাড়পত্র, তথ্য পাওয়ার স্বচ্ছতা ইত্যাদি। রাজ্য সরকার মূলত পাঁচটি ক্ষেত্রে সেরা সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রথম স্থান পেয়েছে। সেগুলি হচ্ছে ১) এক জানলা পদ্ধতির ই-প্রয়োগ, ২) শিল্পের জন্য উপযুক্ত জমি পাওয়া, ৩) লগ্নি সংক্রান্ত তথ্য সহজে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পাওয়া, ৪) সহজেই নির্মাণ ছাড়পত্র পাওয়া এবং ৫) পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া।
শিল্প দপ্তর সূত্রে খবর এই বছরও জিএসডিপি বৃদ্ধির হারে ১ নম্বর রাজ্য (at current prices FY’17-18), রাজ্যের জিভিএ বৃদ্ধি দেশের সার্বিক বৃদ্ধির থেকে বেশি, দেশের তুলনায় শিল্পক্ষেত্রে রাজ্যের বৃদ্ধি ১৯৪% বেশি, সারা দেশের মধ্যে এমএসএমই(in credit lending) তে প্রথম স্থান। গত চার বছর রাজ্যে (বিজিবিএস) লগ্নির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২০১৫ সালে ২৪,৩,১০০ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ২,৫০,২৫৩.৭৪ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে ২,৩৫,২৯০.০৩ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ছিল ২১,৯,৯২৫ কোটি টাকা।  এই বছর শিল্প সম্মেলনে প্রস্তাবিত লগ্নির পরিমাণ ২,৮৪,২৮৮.৩৩ কোটি টাকা।
কলকাতার ফরাসি কনসাল জেনারেল সূত্রের খবর, এবারের বিশ্ববঙ্গ শিল্প স্মম্মেলনে ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণীর শিল্প সংস্থার ২২ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের বাণিজ্যিক দল এসেছিলেন। এই বাণিজ্যিক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত আলেক্সজান্ডার জেগ্লার (Alexadre Ziegler) এবং কলকাতার ফরাসি কনসাল জেনারেল ভার্জিন কোর্টেভাল(Virgine Corteval)। বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনে ফরাসি রাষ্ট্রদূত আলেক্সজান্ডার জেগ্লার বলেন, ‘’জানুয়ারি মাসে গুজরাট এবং তামিলনাড়ু শিল্প সম্মেলনে আমাদের দেশের শিল্প প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেছে। এবছর থেকে আমরা পশ্চিমবঙ্গকে বিনিয়োগের জন্য গুরুত্ব দিচ্ছি। ভারতে ৬০০ কোম্পানীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ রয়েছে।‘’
বিরোধীরা রাজ্য সরকারের লগ্নির কথা মানতে নারাজ। আলোচ্য প্রতিবেদককে একান্ত সাক্ষাৎকারে তাঁরা জানিয়েছেন, বিনিয়োগের কথা সরকার বলছে কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে কোথায়? বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘’গত চার বছর ধরে সরকারি টাকায় মোচ্ছব হচ্ছে কিন্তু রাজ্যে চাকরি, কাজ না পেয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে যুব সম্প্রদায়। রাজ্যে বিনিয়োগ হলে আমরা আপত্তি করব কেন? রাজ্যে কর্মসংস্থান কি বেড়েছে?’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, আমি গত বছর ডানকুনিতে ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে যেটা বলেছিলাম, আজও আপনাকে সেই একই কথা বলছি। তিনি বলেছিলেন, ‘’মুখ্যমন্ত্রী বিদেশ যাচ্ছেন লগ্নীর জন্য। ভালো কথা। দেশ বিদেশের বিনীয়োগকারীরা আসছেন শুনছি। কিন্তু কোথায় শিল্প? কোথায় কাজ? এখন এসে দেখে যান সিঙ্গুরে।‘’
কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বলেন, ‘’এই বছরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের যে বহর দেখছি তাতে তো রাজ্যের পরিসর বাড়াতে হবে। আমার শুধু একটাই কথা, গত কয়েক বছরে যত বিনিয়োগ হয়েছে বলে ‘দিদি’-র সরকার দাবি করছে তাতে রাজ্যে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা। বিনিয়োগের পরিমাণ এবং কতজন বেকার চাকরি পেয়েছেন এই দু’টো বিষয়ে রাজ্য সরকার যদি একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তা হলে ভালো হয়।‘’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবছর বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনের শেষদিনে যেটা বলেছেন সেটাই সম্ভবত বিরোধীদের তোলা প্রশ্নের উত্তর হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘’বিনিয়োগ মানে ব্যবসা। যার মূল লক্ষ কর্মসংস্থান। আমি নিশ্চিত, এই লগ্নির হাত ধরে অন্তত ৮-১০ লক্ষ কাজের সুযোগ তৈরি হবে আমাদের রাজ্যে।‘’                                 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?