ভাষামেলা বই বেলা

দীপেন্দু চৌধুরী
ছেলেটির হাতে গুপি যন্ত্র। প্রাণ খুলে, গলা ছড়ে বাউল গান গাইছে, ‘’নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভোমরা/ নিশীথে যাইও ফুলবনে।।/ নয় দরোজা করি বন্ধ/ লইয়ো ফুলের গন্ধ হে/ অন্তরে জপিয়ো বন্ধুর নাম হে ভোমরা। বাউল ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমালাম। জানতে পারলাম ও বীরভূমের জয়দেব কেন্দুলির কাছে একটা গ্রামে থাকে। স্নাতক পাশ করে চাকরি না পেয়ে চাষবাস করে। বাড়িতে কয়েক বিঘা জমি আছে। তাই বাউল গান গেয়ে মাধুকরী করতে হয় না। তবে ওর গান শুনে কেউ দু’চার টাকা দিলে আপত্তি করে না। ওর কথায় ‘বিজন ঘরে এসে পড়ি যখন পেটটোতো চালাতে হবেক? কি বুলেন? মুখে ভাষা আছে কলাখোলায় শুইয়ে পড়লি হল।’’
আমরা গত কয়েক দশকে জেনে গেছি কলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলা বিশ্বের সেরা বইমেলা। আবার কেউ কেউ দাবি করছে এই বই মেলাকে ভাষামেলা বললে কি অত্যুক্তি হবে? ২ ফেব্রুয়ারি ছিল ভয়েস অব আমেরিকার একটি অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল কলকাতার আমেরিকান সেন্টার। ইউ এস প্যাভেলিয়নে এই অনুষ্ঠানে আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন জেলার শ্রোতারা এসেছিলেন। ছিলেন প্রতিবেশী দেশ বাংলাদশের শ্রোতা। সুদূর বাংলাদেশ থেকে কলকাতা বই মেলায় এসে ওইদিনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার একজন শ্রোতাভারত, রোমানিয়া, আমেরিকা এবং মেক্সিকোর পাঁচজন কবির কবিতা সংকলনের একটি সিডি এবং প্রচ্ছদ প্রকাশিত হয় এই অনুষ্ঠানে। ভারত থেকে বিজয় ভকত, রোমানিয়া থেকে ত্রান্দাফির সিম্পেট্রু (Trandafir Simpetru), এই কবি ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, লারা গ্রাফট (Loradana Vitelaru Nicoleta), আন্সা মারিয়া ডেভিড(Anca Maria David), মেক্সিকো থেকে আহডেজ ফেলিপে (AHdez Felipe) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আছেন জুয়ানিটা আরমেন্ডারিজ(Juanita Armendariz)
১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘ভয়েস অব আমেরিকার’ বাংলা বিভাগ এই বছর ৬১ বছরে পা দিল। জানতে পারলাম ওই দিনের আলোচনা সভা থেকে। আলোচনা সভায় বক্তা ছিলেন বরিষ্ঠ সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী। বর্তমানে দীপঙ্করবাবু ভয়েস অব আমেরিকার কলকাতার প্রতিনিধি। তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় ছিলেন তিন দশক। মধ্যে কয়েক বছর ভয়েস অব আমেরিকা-এর ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেছেন। তিনি ভয়েস অব জার্মানি-এর প্রতিনিধি হিসাবে জার্মানিতেও কাজ করেছেন। তার সঙ্গে কলকাতার ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার কলকাতার আরও একজন প্রতিনিধি। তরুণ সাংবাদিক পরমাশিষ ঘোষ রায়। আলোচনা সভায় ছিলেন কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের মিডিয়া এবং জনসংযোগ বিভাগের ম্যানেজার দীপা দত্ত এবং আমেরিকান লাইব্রেরির ডাইরেক্টর সুশান্ত ব্যানার্জী।
সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘’আধুনিক প্রযুক্তির কারণে পুরনো শ্রোতাদের অনুষ্ঠান শুনতে অসুবিধা হচ্ছে। শ্রোতাদের এই অভিযোগ আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা বিচ্ছিন্ন হতে পারি নাপুরনো এবং নতুন প্রযুক্তির মেলবন্ধন করেই আমাদের অনুষ্ঠান করতে হবে।‘’
৬ ফেব্রুয়ারি নিয়োগী বুকস থেকে প্রকাশিত হয় গুলাম মুর্শিদের লেখা ‘হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতি’-এর ইংরেজি সংস্করণ। বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন শর্বরী সিনহা। বই প্রকাশের পরে ছিল এক ঘণ্টার আলোচনা এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব। আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন লেখক গুলাম মুর্শিদ, অনুবাদক শর্বরী সিনহা এবং অধ্যাপক অমিয় দেব। বাংলা মূল বইয়ের লেখক গুলাম মুর্শিদ আলোচ্য প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘’ হ্যাঁ আমি আগে বলেছি দু’এক জন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বাঙালির ইতিহাস লিখেছেন সংকীর্ণ অথবা সীমাবদ্ধ দৃষ্টভঙ্গি থেকে। আমি চেষ্টা করেছি সেই তথাকথিত সংকীর্ণতার বেড়া ভাঙতেআপনার সঙ্গে আমি একমত যে নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস লিখেছেন। তিনি বঙ্গদেশের ইতিহাস লিখেছিলেন। ওই বই লেখার ক্ষমতা আমার নেই। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাঙালির ইতিহাস লিখেছিলেন।‘’      
১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলার শেষদিন ছিল। তার আগেরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি রবিবার বইমেলা পালিত হয় ‘’বাংলাদেশ দিবস’’ হিসেবে। প্রতিবছর এই দিবস পালিত হয়। কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই দিবসের আয়োজন করে। কলকাতা বইমেলায় ‘বাংলাদেশ প্যাভেলিয়ন’ তৈরি হয়েছিল ঢাকার রোজ গার্ডেনের আদলে। বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অধিদপ্তর, শিশু একাডেমি সহ ৪১ টি প্রকাশনা সংস্থা ছিল বাংলাদেশ প্যাভেলিয়নে।
বইমেলা যে ভাষামেলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলা কথা থেকেও বোঝা যায়। ৪৩তম বইমেলার উদ্বোধনে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হওয়া ৮৭টী বইয়ের লেখক তিনি । মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘’সব ভালো যার শেষ ভালো। বইমেলা হোক ঘরের আলো।‘’ বীরভূম থেকে আসা বিএ পাশ বাউল গাইছে ‘পদ্ম যেমন ভাসে গঙ্গার জলে রে ভোমরা/ নিশীথে যাইও ফুলবনে।’        





Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?