যুক্তিবাদী কলমে লেখা বাংলার ‘হাংরি’ প্রজন্মের উপাখ্যান



দীপেন্দু চৌধুরী
মানব সভ্যতার প্রথম যুগে ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দটার সঙ্গে তৎকালীন সভ্যতার কোনরূপ পরিচয় ছিল না। পরিচয় থাকার কথাও নয়। তবে ‘মোড়ল’ শব্দ অথবা সর্দার শব্দ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার কারণ একটি গোষ্ঠীর মাথা হিসেবে একজন ব্যক্তির শারীরিক ক্ষমতা এবং কৌশলী ক্ষমতা। পাশাপাশি এই সম্প্রদায়ের সুচতুর বৌদ্ধিক বিকাশের ফলে সমাজ পেয়েছিল বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। এই বর্ণাশ্রমের কারণে সমাজকে চারটে ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। প্রথম বর্ণের মানুষেরা ‘বর্ণশ্রেষ্ঠ’ হওয়ার দাবিতে সমাজের পরিচালন ব্যবস্থার শীর্ষে অবতরণ করার অধিকার পায়। পরে এরাই বুদ্ধি চর্চার ‘টোল’-এর অন্যতম কারিগর হয়। এঁদেরকেই সভ্যতার অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে ধরে নিয়ে বুদ্ধিজীবীর তকমা দেওয়া হল। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাবস্থায় সব নাগরিককে তিনটে স্তরে ভাগ করা হয়েছিল। শ্রমিক, কৃষক এবং বুদ্ধিজীবী।  
সভ্যতার প্রথম যুগে অধিকাংশ মানুষ ছিল শিকারি এবং পশুপালক। পরে এল কৃষি, শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি। কায়িক শ্রমের তুলনায় মানসিক শ্রম ছিল সেই সময় কম। কিন্তু বৌদ্ধিক শ্রেণির উত্থানের পরে মানসিক শ্রম বাড়তে থাকে। এবং মানসিক শ্রম আলাদাভাবে গুরুত্ব দাবি করে সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে।
স্বাধীন ভারতের বাংলার বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্ব প্রাক ব্রিটিশ যুগেও ছিল। নবাবি আমলে এক ধরণের আমলাতন্ত্র বা ‘ব্যুরোক্রাসি’ গড়ে উঠেছিল। পাশাপাশি ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ব্যাবস্থাও সমানভাবে ছিল। নাবাবি আমলের আমলাতন্ত্রকে হেগেল বলেছেন, ভারতে বাঙালিরাই প্রথম ইংরেজি ভাষা এবং ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। বুদ্ধি চর্চা এবং রুজি রোজগারের টানে। সেই কারণেই সম্ভবত প্রবাদ হয়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত উক্তি ‘বাংলা আজ যা ভাবে ভারত তা কাল ভাবে।’ স্বাধীন ভারতে ষাটের দশকে আমাদের বাংলায় ইউরোপ, আমেরিকার আলোয় আলোকিত ‘হাংরি’ আন্দোলন শুরু হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদে শিল্প, সাহিত্যের আঙিনাকে বেছে নিয়েছিল এই আন্দোলনের কুশীলবেরা। মানবাধিকার এবং মানবতার দাবিতে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আমাদের রাজ্যে এই আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন মলয় রায় চৌধুরী।
ষাটের দশকের এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে বিষয় করে একটি বই লিখেছেন সাংবাদিক, কবি মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী। বইটির নাম ‘দ্য হাংগ্যারয়ালিস্টস’ (The Hungryalists) ইংরেজি ভাষায় লেখা বইটির প্রকাশক পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া। সম্প্রতি কলকাতার অভিজাত বই বিপণী অক্সফোর্ড বুক্স-এ বইটি প্রকাশ হয়। ১৮৭ পাতার বইটি প্রকাশ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক আনন্দ লাল বলেন, ‘’প্রত্যেক শিল্পীর সত্যের জন্য প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। তা না হলে সমঝোতা করতে হবে। মৈত্রেয়ী সেটা করেনি। ভারতে আমাদের বাংলায় এই আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন এনেছিল। ষাটের দশকের বাংলার প্রতিষ্ঠিত কবিরা এই আন্দোলনের সমর্থনে  কবিতাও লিখেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর পশ্চিমের দিকে তাকালে আমরা শিল্প সংস্কৃতি জগতের অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পাব। যারা হাংগ্যারিয়ালিস্ট আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন।‘’ অধ্যাপক আনন্দ লালের পরেই সঞ্চালক নিবেদিতা ভট্টাচার্য আমাদের মনে করিয়ে দিলেন, এই আন্দোলন ‘প্যান ইন্ডিয়ায় ছিল না। আমি প্রবাসী বাঙালি হিসেবে এই বাংলায় আন্দোলন দেখেছি।’ আমরা জানলাম হাংগ্যারিয়াস্টরা সামগ্রিক রচনায় বিশ্বাস করে না। আলোচক মধুবন্তী রায় চৌধুরী বিষয়টা বিস্তারিত আলোচনা করেন।  
অধ্যাপক আনন্দ লাল আরও বলেন, ‘’বুক ইজ পাস্ট ট্রুথ অফ দ্য ট্রুথ। এই বই সেই শর্ত পূর্ণ করেছে। সত্যের খোঁজে মৈত্রেয়ী অনুসন্ধান করে বই লিখেছে। এই বইয়ের ভাষ্য বা ‘স্পিরিট অব দ্যা বুক’ তাই বলে।‘’
২০১৩ সালের ক্রসওয়ার্ড পুরষ্কারজয়ী কবি তিনি। আরও দু’টি বইয়ের লেখিকা মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্যের নিজের কথায়, তিনি অসমের বিষয় নিয়ে লিখতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা লেখেননি। প্রবাসী বাঙালি হিসেবে ষাটের দশকের অগ্নিগর্ভ বাংলা তাঁকে ভাবিয়েছে। বইটা লিখতে মৈত্রেয়ী সময় নিয়েছেন তিন থেকে সারে তিন বছর। এই বই লেখার সময় লেখিকাকে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ তথ্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। তাঁর অনুসন্ধানের বিষয় শুধুমাত্র বৌদ্ধিক চর্চায় আটকে থাকেনি। গাঁজা, মদ, চুল্লু, হাঁড়িয়া, বিড়ি, সিগারেট সব বিষয়কে ঘেটে দেখতে হয়েছে লেখিকাকে। ষাটের দশকের ছাত্র যুবদের এই আন্দোলন নিয়ে লেখার কারণে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন এই আন্দোলন করার জন্য। ব্যাঙ্গালোর রিভিউয়ের বিনোদন শাখার সম্পাদক তথা সাংবাদিক এবং লেখক মৈত্রেয়ী বলেন, ‘’কবি হিসাবে এই বইয়ের বিষয়টা ভেবেছি। প্রাথমিক ভাবে ঠিক করি এটা ‘ফান’-কে বিষয় করে লিখব। যেমন অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম কলকাতায় অভিজাত থেকে দরিদ্রতম মানুষ সবাই গাজা খায়। তবে ‘ফান’ হিসেবে লিখতে গিয়েও অনেক গুলি বিষয় আছে সত্য নির্ভর।‘’
বাংলার রেনেসাঁস নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। সেই সময়ের নবজাগরণকে আদৌ বাংলার নবজাগরণ বলা যায় কিনা এই বিষয়ে ইতিহাসবিদ, নৃতত্ববিদদের গবেষণালব্ধ মতামত রয়েছে। কারন বাংলার রেনেসাঁ ছিল বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীন ভারতে ‘হাংগ্যারিয়ালিস্ট’-দের আন্দোলন ছিল আধুনিক শিল্প সাহিত্যের মাধ্যমে মত প্রকাশের সমর্থনে। সৃষ্টিশীল এক দল খ্যাপাটে কবি, লেখক, শিল্পীদের সমর্থনে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার জন্য কবি, লেখক এবং শিল্পীরা তুলি, কলম, ক্যানভাস বেছে নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল খ্যাপাটে মনন। হয়ত কলম ছাড়াও তাঁরা বাহ্যিক আঙ্গিকও বেছে নিয়েছিলেন। প্রতিবাদের নজর কাড়ার ভাষা হিসেবে। এবং সেই কারণে হয়ত তাঁদের সামাজিক বয়কটের শিকার হতে হয়েছিল। তথাকথিত সমাজ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং সমর্থদের বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির মানচিত্রের ভাষা তাঁরা বদলে দিতে পেরেছে। আধুনিক শব্দের স্পর্ধায়, আধুনিক কবিতা, গল্প, আখ্যানের আবেদনে। লেখিকার দাবি তিনি মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়গুলি দেখেছেন। মুক্ত মনের দিশারি হয়ে।      
লেখিকার আলোচ্য বইয়ের প্রচ্ছদের দ্বিতীয় পাতায় লেখা হয়েছে, ‘’What happens to a highbrow literary culture when its fault lines-along caste, class and gender-are brutality exposed? What happens to the young iconoclasts who dare to speak and write about these issues openly? Is there such a thing as a happy ending for revolutionaries? Or are they doomed to be forever relegated to the footnotes of history?
This is the never-before-told true story of Hungry Generation (or ‘the Hungryalists’)- a group of barnstorming anti-establishment poets, writers and artists in Bengal in the 1960s. Barring social boycott, ridicule and arrests, the Hungryalists changed the literary landscape of Bengal (and Many South Asian countries) forever. Along the way, they also influenced iconic poets, such as Allen Ginsberg, who struck up a lifelong friendship with the Hungryalists.’’               
                 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?