স্বীকৃত জ্যোৎস্নায় বিতর্কিত সেলুলয়েডের জীবন



দীপেন্দু চৌধুরী 
যে দেশটাকে নিয়ে আজও বিতর্ক থামে না সেই দেশের প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে? দেশটার অতীত দেশটাকে থামতে বলেনি। আক্ষেপ করতেও বলেনি। সমাজ উন্নয়নের সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রের যে আত্মিক সম্পর্ক, এই কথা আমাদের আবার মনে করতে হয়। পাশ্চাত্যের শিল্পের জাদুকাঠির ছোঁয়ায়। আবার একবার অনুভব করলাম কয়েকদিন আগে। সেলুলয়েডের পর্দায় দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না। ক্যামেরার লেন্সের স্পর্ধিত অভিজাত ভাষা আমাদের নাৎসি জার্মান, বার্লিন প্রাচীর, আগ্রাসী সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি, পশ্চিম জার্মানি এই সব বিষয় ভুলে যেতে বলল। জার্মানের সযত্নলালিত অকৃত্রিম প্রকৃতির মোহময় আবিলতা আমাদের চোখ, মন, মনন সব কিছু উথাল পাথাল করে দিচ্ছিল। প্রেম,ব্যাক্তিক দ্বন্দ, সেলিব্রেটি অভিনেত্রীর বিতর্কিত জীবনের অধ্যায় পরতে পরতে খুলে দিচ্ছিল পরিচালকের মুনশিয়ানা। সাগরের শান্ত ঢেউ, যত্নে এবং প্রযত্নের সৃষ্টিশীল ঝড়ো হাওয়া একসময়ের অস্থির জার্মান নামক দেশটির ইতিহাস আমাদের সামনে আছড়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল সিনেমা দেখছি না প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা রঙের বর্ণনা পড়ছি। ইতিহাস পড়ছি, সভ্যতাকে জানছি নতুন ভাষায়। একুশ শতাব্দীর আধুনিকতায় জীবন শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি মনে হচ্ছিল। আবার বিশ্বাস করলাম ক্যামেরার চোখ কথা বলে। আমাদের ভাবতে শেখায়। হাসতে বলে। কাঁদতে শেখায়। সোজা হয়ে হাঁটতে বলে।    
কলকাতায় শীতের সময় বরফ পড়ে না। আমরা বরফের দেশের ছবি দেখে, সিনেমা দেখে কুচি কুচি বরফের গল্প বলি। গল্প শুনি। ২০১৮ সালে পুরষ্কার-পাওয়া মোট দশটি জার্মান ছবির উৎসব ‘দ্য জার্মান লেন্স’ আয়োজন করেছিল গ্যোটে ইনস্টিটিউট ম্যাক্সমুলার ভবন। ১৮ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল এই দশটি ছবির প্রদর্শনী। প্রথম দু’দিন প্রদর্শন ছিল কলকাতা শহরে সিনেমা দেখার অন্যতম পীঠস্থান নন্দনে। নন্দন ২ এ। তৃতীয়দিন ছিল ম্যাক্সমুলার ভবনে। সারা বিশ্বে এই প্রথম দ্য জার্মান ফিল্ম অ্যাকাডেমি এবং গ্যোটে ইনস্টিটিউট যৌথভাবে পুরষ্কারজয়ী জার্মান ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করল। ছবিগুলি বেছে নেওয়া হয়েছে কাহিনীচিত্র, ছোটদের ছবি, স্বল্প দৈর্ঘের ছবি এবং তথ্যচিত্রের তালিকা থেকে। এবং ছবিগুলি প্রদর্শিত হয়েছে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রীসে। ছবিগুলি পুরস্কৃত করার ক্ষেত্রে জুড়িরা যেমন আলোচনা করেছেন পাশাপাশি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করার ক্ষেত্রে  মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন কাটজা এচিঙ্গেজ(Katja Eichinger) এবং গ্যোটে ইন্সটিটিউটের বোর্ড চেয়ারম্যান জোহান্স এবের্ট (Johannes Ebert)। এই ছবিরডালি প্রদর্শনের আগে ধারবাহিক কর্মশালা এবং আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আথেন্স, বস্টন, পোর্টল্যান্ড, কলকাতা এবং নিউ দিল্লিতে ছবিগুলি প্রদর্শিত হবে।
জার্মান ফিল্ম অ্যাকাডেমির বর্তমান সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ১৯০০। জার্মান ফিল্মের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত অভিনেতা, অভিনেত্রী, শিল্পী,  ক্যামেরাম্যান, চিত্রনাট্যকার এবং কারিগরি বিভাগের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্যরা এই ফিল্ম অ্যাকাডেমির সদস্য। এই অ্যাকাডেমি সারা বছর ধরে ইউরোপের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে শিল্পের দাবি মেনে নির্মিত সিনেমা তৈরি এবং প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে আসছে। যেমন এবছরের জানুয়ারিতে আমরা পেলাম পুরষ্কারজয়ী ১০টি জার্মান ছবি। ১৮ জানুয়ারি প্রথম ছবিটি ছিল ‘মাউন্টেন মিরাক্যাল-অ্যান আনএক্সপেক্টেড ফ্রেন্ডশিপ। (এমিলি রেন্নট’)। পরিচালক টোবিয়াস উইয়েমান (Tobias Wiemann) একটি পরিচিত অসুখকে প্রকৃতির সবুজ মায়ায় চুবিয়ে অন্যতম একটি সামাজিক ছবি উপহার দিয়েছেন এই চিত্রগল্পে মাত্র ৯৭ মিনিটের ছবি। আল্পসের কোলে পাহাড়ি সবুজ ঘেরা একটি মন কেমন করা গ্রামে হাপানির চিকিৎসা করতে আসে এমিলি নামের মুখ্য কিশোরী চরিত্রটি। বার্লিন শহরে খোলামেলা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছটফটে কিশোরী এমিলি নামের মেয়েটি ‘হেলথ রিসর্ট’ -এর বাধাধরা নিয়ম মেনে নিতে পারে না। জামার পকেটে ইনহেলার আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক ব্যাগ নিয়ে সে বেড়িয়ে পড়ে অজানার আনন্দে। হাতে ছিল স্মার্টফোন। টাওয়ার থাকলেই সে পেয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবীকে। পরিচালক ক্যামেরার ভাষায়, চিত্রনাট্যের সংলাপে, ইনহেলার নেওয়ার মানসিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই ছবি আমাদের উপহার দিয়েছেন। এমিলি ছবির মতো আল্পসের কোলে একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে মুক্ত হওয়ার আনন্দে দু’চোখ দিয়ে অচেনার আনন্দে প্রকৃতিকে চুম্বন করে। মাথার উপর গাছে বসে হলুদ পাখি। ‘হুতোম’ মানে লক্ষ্মী পেচা সাহসী চোখে চেয়ে আছে এমিলির দিকে। এইভাবে গল্প এগিয়ে যায়। এমিলির সঙ্গে পরিচয় হয় সমবয়সি এক রাখাল বালকের সঙ্গে। সেই রাখাল বালক এমিলিকে জীবনে ফিরে আসার জন্য আকুল আকুতি জানায়। আঁকাবাঁকা পাকদন্ডি পাহাড়ি পথে তাঁকে বারে বারে সাহায্য করে। সেই রাখাল বালক। এক সময় এমিলি প্রমাণ করে ‘হাঁপানি’-তে মানুষের মৃত্যু হয় না। ‘হাঁপানি’ মানুষের স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিতে পারে না।
প্রথমদিন ছবি নিয়ে ছিল একটি আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় ছিলেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার সহ সভাপতি প্রেমেন্দ্র মজুমদার এবং জার্মান চলচ্চিত্র পরিচালক জুলিয়া লাঙ্ঘফ (julia Langhof)। জুলিয়া বলেন, ‘’বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কলকাতার আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। সিনেমার শহর, সংস্কৃতির শহর কলকাতা। উঁচুমানের দর্শক, সমালোচক আছেন এই শহরে। এই শহরে আস্তে পেরে আমি গর্ব বোধ করছি।‘’  
ছবি ছিল বিশ শতকের জার্মান ভাস্কর-শিল্পীকে নিয়ে, কুড়ি বছর ধরে চলা কঙ্গোর মানুষদের দমন পীড়নে জর্জরিত কঙ্গোর মানুষদের নিয়ে তথ্যচিত্র। পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি গড়ে ওঠার সময়কার বাস্তব জীবনের গল্পের ভিত্তিতে তৈরি ছবিও রাখা হয়েছিল এই দশটি ছবির তালিকায়। কিন্তু আমরা সেরা ছবি পেলাম ২০ জানুয়ারি। ম্যাক্সমুলার ভবনে দেখলাম এমিলি আটেফ (Emily Atef) পরিচালিত ১১৫ মিনিটের কাহিনীচিত্র ‘থ্রি ডেজ ইন কিবেরন’। এই ছবিটি গত বছর জার্মান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস- এর সেরা ছবির পুরষ্কার জিতে নিয়েছে। একটি স্পা হোটেলে রোমি স্কেনেডর (Romy Schneider) নামে ইউরোপের একজন খ্যাতনামা চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর জীবনী অবলম্বনে ছবিটির কাহিনী গড়ে উঠেছে। খামখেয়ালি লব্ধ প্রতিষ্ঠিত রোমি তার শেষ সাক্ষাৎকার দেয় ‘স্টারন’-এর দু’জন সাংবাদিককে।
এই সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে একজন শিল্পীর স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রের দ্বন্দ, প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, জীবনের বিভিন্ন বাঁক, সামাজিক আঘাত, পারিবারিক আঘাত, প্রেম, সংসার, প্রথম স্বামীর আত্মহত্যা, সন্তানদের সময় দিতে না পাড়ার ব্যক্তিক যন্ত্রণা,  প্রত্যেকটা বিষয় এসেছে অতি ধুরন্ধর বুদ্ধিদীপ্ত সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ প্রশ্নে। রোমি প্রশ্নে প্রশ্নে বিদ্ধ হয়েছেন, ক্লান্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন, যন্ত্রণা পেয়েছেন তবু উত্তর দিয়েছেন। সঙ্গে থাকা অতি ঘনিষ্ট সংবেদনশীল এবং সচেতন বান্ধবী হিল্ডে (Hilde) সাংবাদিককে আটকাতে চেষ্টা করেছেন। বান্ধবীকে সতর্ক করেছেন, ‘ওরা সুযোগ নিচ্ছে। তোমার এই গল্প ওরা মোটা টাকায় বিক্রি করবে। তুমি কেন সব কথার উত্তর দিছ?’  কিন্তু রোমি সাক্ষাৎকার বন্ধ করেননি। বান্দবীকে বলেছেন, ‘তুমি এখন যাও। আমি পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।’ এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খ্যাতনামা অভিনেত্রী। পরেরদিন আবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ১৯৮১ সালে তার মৃত্যুর একবছর আগে ইউরোপের খ্যাতনামা অভিনেত্রী রোমী এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন।
শেষ দৃশ্যে দর্শকদের সামনে পর্দায় অভিনেত্রী উপস্থিত হলেন। সঙ্গে শিশু সন্তান। সামনে পরিচিত চিত্র সাংবাদিক। সে সাক্ষাৎকারের পুরো বয়ানের রোমান হরফে টাইপ করা কয়েকটি কাগজ অভিজাত অভিনেত্রী রোমির হাতে দেয়। ইউরোপের স্বনামধন্য অভিনেত্রী রোমি সাক্ষাৎকারটি একবার পড়ে নিয়ে খস খস করে সই করে নিজের স্বীকৃতি দিয়ে দেন। আমরা স্বকন্ঠে উচ্চারণ করি, স্বীকৃত জ্যোৎস্নায় বিতর্কিত সেলুলয়েডের জীবন। ম্যাক্সমুলার ভবনের সভাঘরের দর্শকরা আবেগে আপ্লুত হয়ে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন সাহসী জীবনশিল্পকে। সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীকে এবং সাহসী সংবেদনশীল চলচ্চিত্র পরিচালক এমিলি আটেফ (Emily Atef) কে। এমিলি আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এই শ্রমজীবী প্রতিবেদকের। বাস্তব যতই তেতো হোক, যতই কঠিন হোক একদিন না একদিন সামনে আসবে। এই সত্য আপনি আমাদের সিনেমা এবং সেলুলয়েডের কবিতার ভাষায় চিনতে শিখিয়েছেন। আমরাও জীবনশিল্পের সঙ্গে দীর্ঘ পথ হাঁটতে চাই।               

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?