ঋণ মকুব না ভারতীয় কৃষকের চাই আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো





দীপেন্দু চৌধুরী
মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠনের পরে পরই রাজ্যের কৃষকদের ঋণ মকুব করলকিন্তু তাঁর পরেও কি কৃষকের আত্মহত্যা বন্ধ হল? মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ ঋণ মকুবের ঘোষণার করার পরে পরেই এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। ২২ ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া জেলার পান্ধানা বিধানসভা ক্ষেত্রের আতারিয়া গ্রামের আদিবাসী কৃষক গাছে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কমলনাথের সরকার ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কৃষিঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আত্মঘাতী আদিবাসী কৃষক ২০১৮ সালের ৩১ মার্চের পরে কেন্দ্রীয় সরকার অধিগৃহীত ব্যাঙ্ক এবং সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল। তাঁর পারিবারিক জানিয়েছে, সরকারি ঘোষণা শুনে তিনি মুষড়ে পড়েন। তার পরেই আত্মহত্যা।
মাথাপিছু আয়ে যে রাজ্যগুলি ধনী সেইসব রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যা সব থেকে বেশি। ২০০১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যার পরিসংখ্যান ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় কেরলে প্রতি লক্ষ কৃষকের মধ্যে ১৬৩ জন আত্মহত্যা করেছিল কৃষক আত্মহত্যার হারের পরিসংখ্যান ছত্তিষগড় ৩৩.০৯, মহারাষ্ট্র ৩২.৬০, কর্ণাটক ৩১.৬২, অন্ধ্রপ্রদেশ ২৬.০১,পশ্চিমবঙ্গ ১৯.৬৮, তামিলনাড়ু ১৮.৭৯, মধ্যপ্রদেশ ১৩.৮১। কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল পুডুচেরিতে কৃষিজীবী সংখ্যা কম তবু সেই রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার হার প্রতি লক্ষে ১৫৬ জন। মানব উন্নয়ন সূচকেও যে সব রাজ্য এগিয়ে আছে। সেই সব রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি। ব্যতিক্রম মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড় রাজ্য।
এই পরিস্থিতিতে নজর ফেরাতে হয় গত বছরের লাগাতর কৃষক আন্দোলনের দিকে। মার্চ মাসের ৪০ ডিগ্রি গরমে নাসিক থেকে মুম্বাই ১৮০ কিলোমিটার ‘কিষাণ লং মার্চ’ হয়েছে। বলা যায়, দুনিয়া কাঁপানো ছয় দিনের লং মার্চ। হেঁটে আসা কৃষকদের হা মুখ পায়ের ছবি দেখে চমকে উঠেছিল গোটা দেশ। চটি ছিঁড়ে ফুটিফাটাপায়ে ফোসকা, ছালচামড়া উঠে লাল মাংস দেখে বাবুসমাজ শিহরিত হয়েছিলসেই মিছিলের ৯০ শতাংশ ছিলেন আদিবাসী কৃষকতাঁদের দাবি ছিল জমির পাট্টা। নাসিক থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের দিন্দোরির আদিবাসী গ্রামের প্রাক্তন সরপঞ্চ সিন্ধুবাই গায় কোয়াড়ও হেঁটেছিলেন সেই রক্তঝড়া মিছিলেসম্প্রতি তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘’পাট্টা মিললে জমিতে সেচের জল আসে। কৃষিঋণ মেলে। ফরেস্টের বাবুদের জ্বালাতন বন্ধ হয়। না হলে যখন-তখন পোষা মুরগি, ছাগল উঠিয়ে নিয়ে যায়। গ্রামসভা পাট্টার সুপারিশ করলেও কাগজ আটকে রাখেন সরকারি বাবুরা।‘’
২০০৬ সালে মনমোহন সিংহের সরকার অরণ্যের অধিকার আইন এনেছিল। আইনে বলা আছে, জঙ্গলের জমিতে যারা বাস করেন তাঁদের জমির আইনি স্বত্ব পাওয়া যাবে। ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রী মোদির  সরকার আদিবাসী কৃষক এবং ছোট চাষিদের দাবি নিয়ে মাথা ঘামায়নি প্রশ্ন উঠছে, ভারতীয় কৃষকদের ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করা নিয়ে। গত কয়েক দশকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন রাজ্যে ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন। এই প্রবণতা কেন? ঋণখেলাপি হওয়াই কি আসল কারণ? না ভারতীয় আর্থ-সামাজিক গঠন এই প্রবণতা রোখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে? আমাদের দেশে উত্তর বিশ্বায়ন উদার অর্থনীতির সময়ে,  একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও ১৭ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। কত পরিবার সন্তান বেচে দেয় দারিদ্রের কারণে। ১৮ কোটি ভারতবাসির মাথার ছাদ নেই।
ইউপিএ সরকারের সময়ে জিডিপি বৃদ্ধির হার বেশ উঁচু ছিল। ৬ থেকে ৭ শতাংশ। চিনের পরেই ভারতের অবস্থান ছিল। বিদেশের চোখে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি সাফল্যের কাহিনী তখন তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি এবং পরিসেবা ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতি সাফল্যের আলো দেখলেও কৃষিক্ষেত্রটি অবহেলিত থেকে গেছেপশ্চিমের দেশেরা তাঁদের সংবাদ মাধ্যমে ‘ব্রিক’ (BRIC) দেশগুলির সদস্য ভারতকে একটি গতিশীল অর্থনীতি হিসেবে তুলে ধরলেও ভারতীয় কৃষকদের লংমার্চ গ্রামীণ ভারতের ছবিটা আমাদের সামনে এনেছে।  যার ঝাপটায় বিজেপি তিন রাজ্যে বিধানসভা ভোটে হার মানতে বাধ্য হল। মারাঠি ‘লং মার্চ’-এর শীর্ষ কৃষক নেতা এবং সংগঠক অশোক ধওয়ালকে শিলিগুড়িতে নিয়ে এসে গত ডিসেম্বরে দু’দিনের দু’টি ‘লং মার্চ’ করে উত্তরবঙ্গের সিপিএম নেতৃত্ব। নজরে পড়ার মতো ভিড় হয়েছিল।     
পশ্চিমের দেশগুলি ভারতকে পণ্য এবং পরিষেবার ‘উদীয়মান বাজার’ বলে পত্রপত্রিকায় তুলে ধরলেও গ্রামীণ মানুষের সমস্যার কথা তারা উল্লেখ করছে না। কৃষি এবং শিল্প, যে দুটি ক্ষেত্র এ দেশের মানুষের পঞ্চমাংশ ধারণ করে আছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে সেই দু’টির গতি নিচের দিকে। কৃষিতে ভয়ানক মন্দা। কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। শীতের ফসল দাম না পাওয়ার কারণে জমিতে উৎপাদিত ফসল গবাদি পশুকে খাইয়ে দিতে হচ্ছে। বিশ্বের আর কোন কোন দেশে ভারতের মত এই নিষ্ঠুর বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয় কৃষকদের? অর্থনীতিবিদদের অভিমত বর্তমান ভারতে খাদ্যশস্য গড় ব্যবহার এত কমে গেছে যে সেটা ঔপনিবেশিক সময়ের সঙ্গে তুলনীয়। খাদ্যশস্য রপ্তানি বাড়ছে ঠিকই কিন্তু গ্রামীণ ভারতকে অতিরিক্ত ক্ষুদার ভার বহন করতে হচ্ছে। একটা উদাহারণ টানা যাক। খুব সম্ভবত ২০১০ সালের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কাছে আসানপুর গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষ মণ্ডলের দুই বিঘা জমি ছিল। জমিতে ঘাস নিড়ানির সময় অসাবধানবশত শান দেওয়া কাস্তেতে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে যায়। হাসপাতালে গেলে ডাক্তারবাবুদের কথামতো আঙ্গুলটা বাদ দিতে হয়। তারপর থেকেই সন্তোষের ভাবনা ছিল, কাস্তে ধরবেন কী করে! হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ই শৌচালয়ে সন্তোষের দেহ ঝুলতে দেখা যায়।   
এই বাস্তব অভিঞ্জতা কি বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে ফসল বিমা, কৃষকদের পেনশন চালুর কথা ভাবাচ্ছে? আমাদের রাজ্যে রাজ্য কৃষিদপ্তর সূত্রে খবর রাজ্য সরকার চলতি অর্থবর্ষে সমবায়ের মাধ্যমে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ দিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ শোধ করতে না পারলে ৩% সুদ ছাড় দেওয়া হচ্ছে।  মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করেছেন, ‘রাজ্যে কৃষকদের গড় বার্ষিক আয় ২০১০-১১ সালের আর্থিক বছরে ৯১ হাজার টাকা থেকে তিন গুণ বেড়ে ২০১৭-১৮ সালে ২ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা হয়েছে। আমরা কৃষিজীবীর খাজনাও মকুব করেছি।‘’
ওই আদিবাসী কৃষকের আত্মহত্যার পরে পরেই মধপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথও আরও একটি নতুন ঘোষণা করেছেন। রাজ্যের ৬০ বছরের বেশি বয়সি সব কৃষক এবং তাঁদের পরিবারের জন্য পেনশন প্রকল্প চালু করতে যাচ্ছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁন্ধীর ঘোষণা মতোই কংগ্রেস পরিচালিত রাজস্থান সরকার ১৮,০০০ কোটি টাকা, ছত্তিশগড় ৬,০০০ কোটি টাকা এবং মধ্যপ্রদেশ সরকার ১৮, ০০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ মকুব করেছে। কর্ণাটক সরকারও কৃষিঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার ২০০৮ সালের বাজেটে ৭১ হাজার কোট টাকার কৃষিঋণ মকুবের ঘোষণা করেছিল
কিন্তু গত সাড়ে চার বছরে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের স্বার্থে কতটা এগিয়ে এসেছেন? প্রশ্ন কিন্তু উঠে গেছে। কৃষকরা যে দেনার দায়ে আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য হয়, এটা সরকারি আধিকারিকরা মেনে নিতে চান না। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকরা যে উপেক্ষার শিকার, সেটা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যানগুলি থেকে স্পষ্ট।  তথ্য বলছে, সরকার পরিচালিত এবং সংগঠিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের প্রবেশাধিকারের কোনও সুযোগ নেইফলত তাঁরা এক অদৃশ্য ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন তাই ঋণ মকুব চাষিদের মূল বা একমাত্র দাবি নয়। আমাদের দেশে পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা উত্তর ঔপনিবেশিক সময় থেকেই অপ্রতুল। এর ফলে সমস্ত রকমের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক চাষিদেরভারতেরমতো উন্নয়নশিল দেশে বৃহৎ পুঁজির প্রয়োজনে শিল্পে যতটা বিনিয়োগ হয়, কৃষি ক্ষেত্রে ততটা হয় না। দেশের কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে সব থেকে বেশি প্রয়োজন কৃষিজ ফসলের সংরক্ষণ। যাতে অভাবি কৃষককে তাঁর ফসল নষ্ট না করে ফেলতে হয় কৃষক ন্যায্য দাম পায়। তার জন্য প্রয়োজন প্রতিটি ব্লকে ছোট-বড় একাধিক হিমঘর অর্থাৎ এক কোল্ড স্টোরেজ চেন। সেচ ব্যবস্থার উন্নতি। সেচ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, কৃষি পণ্য পরিবহণের উপযোগী রাস্তার অভাবও ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে। কৃষির উন্নতিতে আরও প্রয়োজন সরকারি ভর্তুকিতে বীজ, কীটনাশক, তেল, সার এবং কৃষি যন্ত্রপাতিভারতীয় ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের দাবি এইসব প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের দাম কমানো হোক। সরকার ফসলের ন্যায্য দামের ব্যবস্থা নিশ্চিত করুক।  
(এই লেখাটি ৮ জানুয়ারি, ২০১৯ বাংলা দৈনিক ‘আজকাল’ পত্রিকায় উত্তর সম্পাদকীয় হিসেবে চতুর্থ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে।)   
           

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?